আমাদের সাম্প্রতিক জাপান সফরে, কর্তা ও আমি কিয়োটো শহরে ছিলাম দিন চারেক. তার মধ্যে একদিন ঠিক হোল কাছের এক ঐতিহাসিক শহর নারা তে যাবো. সেইমত বেরোলাম সকাল সকাল, ট্রেনে ঘন্টা খানেকের মামলা; লোকাল ট্রেন, তবে জাপানি তো, তাই সেও আমাদের শতাব্দী এক্সপ্রেসের মতই তকতকে. নারা স্টেশনে পৌঁছে একজনকে জিজ্ঞেস করলাম নারা পার্ক কতদূর, সে লোকটি তার ভাঙাচোরা ইংরেজীতে বোঝালো মাত্র মিনিট কুড়ির হাঁটা পথ; আমার যা ফিটনেস তাতে নিজের পায়ের ওপর ভরসা না করে ট্যাক্সিতেই চেপে বসলাম শেষমেশ. রাস্তার দুধারে বসন্তের সমারোহ দেখতে দেখতে পার্কের কাছাকাছি এসে গেছি, চোখে পড়ল রাস্তায়, ফুটপাথে গাদা গাদা ছাগলের পাল. জাপান যে আমাদের দেশকেও মাত দেবে ছাগলামিতে! কেমন ভড়কে গেলাম. ভাড়া মিটিয়ে রাস্তায় নেমে বুঝলাম, ছাগল নয়, এরা সব হরিণ. এমন পালে পালে দেখে ছাগল ভেবে ফেলেছিলাম আর কি. তা লোকজন দেখে মোটেও ভয় পায়না তারা, দিব্যি এগিয়ে এসে হাত থেকে খাবার খায়; তাদের খাওয়ানোর জন্যে খাবার কিনতে পাওয়া যাচ্ছে অনেকগুলো ঠেলাগাড়িতে. বুঝলাম, হরিণ ও এখানে একটা ইন্ডাস্ট্রি, ট্যুরিস্টদের খাওয়ানোর হিড়িকে পাশের জংগলের যাবতীয় চারপেয়ে পার্কে এসে জুটেছে, মাঠ ভর্তি ঘাসে তাদের কোনো আগ্রহ নেই; বিনা পরিশ্রমে খেতে পেলে আবার চরে খাওয়া কেন!
নারা পার্কের পাশে বিখ্যাত টোডাই জি মন্দির, আমরা প্রথমে সেখানে গেলাম, নবম শতাব্দীর অনুপম স্থাপত্য, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কাঠের ইমারত. তবে মূল সাততলা মন্দিরটি এখন আর নেই, তবু যা আছে সেও বিস্ময়কর. মন্দিরের গর্ভগৃহে ঢুকতে চড়তে হয় বেশকিছু খাড়াই সিঁড়ি, আমার মত অনেকেরই বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল সেখানে, তবে নধর চেহারার হরিণরা দেখলাম সেখানেও উপস্থিত, তাদের তো আর আমার মত হাঁটুর সমস্যা নেই!
যাহোক, ভগবান দর্শনের পরে, ছবিতোলা ও ডান্ডা বাগিয়ে সেল্ফি তোলার মত অবশ্য কর্তব্য পালন করতে করতে বেশ হাঁপিয়ে পড়েছি, তাই বসলাম গিয়ে মন্দিরের দালানে. সেখানে বসে আছি, হঠাৎ কর্তা ঝটকা মেরে উঠে দাঁড়ালেন, 'এই ব্যাটা আমার জ্যাকেট চিবোচ্ছিল', একটা গোদা হরিণকে দেখিয়ে বলে উঠলেন তিনি. সেই গোদা এখানে সুবিধে করতে না পেরে এগোল কাছেই বসা এক মধ্য বয়সী শ্বেতাঙ্গীনীর দিকে. তাঁর কাছে একটা খাবার প্যাকেট ছিল, ভাবলাম বুঝি সেটাই লক্ষ্যবস্তু. ও হরি, প্যাকেট নয়, মহিলার শার্টটাই বাবাজীর বেশী মনে ধরেছে, শেষকালে সঙ্গের খাবার ঘুষ দিয়ে মহিলা কোনক্রমে বস্ত্রহরণ ঠেকালেন.
এ আবার কেমনতর ব্যাবহার? ভাল ভাল খাবার খেয়ে কি অগ্নিমান্দ্য ঘটেছে, তাই জামাকাপড় চিবিয়ে মুখশুধ্যি করা? ছোটবেলায়, আমাদের পাড়াতে একটা গরু চরে বেড়াতো, সে চটি, গামছা এমনকি সাবান পর্যন্ত চেবাতো মনের সুখে,কি জানি এও সেরকম কিনা!
তবে হরিণের ব্যাদরামোর এখানেই শেষ নয়, পার্কের মাঝখানে ছাউনি ঘেরা বসার জায়গায় বসে আছে বেশ কিছু ট্যুরিস্ট, আমরাও দুজন দুটো আইসক্রিম কিনে সদ্য এককোনে বসেছি. হঠাৎ একটা গোদা শিং বাগিয়ে তেড়ে গেলো উল্টো দিকে বসা দুই থাই তরুণীর দিকে. তারা সঙ্গের যাবতীয় খাবার, মায় জলের বোতল মাটিতে ফেলেও উদ্ধার পায়না, একগুঁয়ে ষাঁড়ের মত ব্যাটা লেগে রইল ওদের সাথে . ওরা নাকের জলে চোখের জলে হয়ে পালিয়ে বাঁচল শেষে. এবার মহাশয় মনযোগী হলেন আমাদের প্রতি. কর্তা বুদ্ধি দিলেন, ওর দিকে তাকিও না, পাত্তা না পেলে চলে যাবে. একটু পরে তিনি নিজেই তিন লাফে বেঞ্চি ছেড়ে ছাউনির বাইরে, উপদেশ কাজে লাগেনি, হরিণ ওঁর জামার নীচে থেকে বেরিয়ে থাকা গেঞ্জি ধরে টেনেছিল. এবার সে তেড়ে এলো আমার দিকে; না জামা নয়, আমার হাতের আইস্ক্রীমটাই লক্ষ্যবস্তু. এদিকে আমি জুতো খুলে বেঞ্চিতে বসা, দৌড়ে পালাতে গেলে দামী জুতোজোড়ার মায়া ছাড়তে হয়, সদ্যকেনা চামড়ার জুতো চিবিয়ে চুয়িংগাম করে দেয় যদি! ফলে আমি আইসক্রীম সমেত হাত উর্দ্ধে তুলে নিমাইয়ের পোজে হাঁ করে চ্যাঁচাচ্ছি, আমার এই কাছা খোলা দশায় ব্যাটার উৎসাহ তুঙ্গে. এসময় আমার উদ্ধারে নামল একটু দূরে বসা একটি চীনে ছেলে, প্রথমে সে একটা হাজার ইয়েনের নোট বের করল, মন্ত্রের মত কাজ হোল তাতে, হরিণ ধেয়ে গেল তার দিকে অসীম আগ্রহে. সে হাঁ করে যেই নোট চেবাতে চেষ্টা করছে, ছেলেটি নোট পকেটে পুরেছে; আর যায় কোথায়, হরিণের নজর পকেটে. এরমধ্যে তার আরও দুটো সাথী সঙ্গ দিতে হাজির, আমার উদ্ধারে নেমে, ছেলেটি তখন কোনঠাসা. কিন্তু, এবার ছেলেটি যা করল, তাতে আরও একবার প্রমাণ হোল চীনেরা সত্যিই অদম্য. ছেলেটি বাঘের আওয়াজে ডেকে উঠল কয়েকবার, কয়েক সেকেন্ডেই ছাউনি হরিণমুক্ত. এরপর আমরা মহা আরামে আইসক্রীম শেষ করলাম; জুতোটা অবশ্য পায়ে গলিয়ে নিয়েছিলাম...... বলা তো যায় না!!
***