বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০১৯

হরিণে হরিল হৃদি

আমাদের সাম্প্রতিক জাপান সফরে, কর্তা ও আমি কিয়োটো শহরে ছিলাম দিন চারেক. তার মধ্যে একদিন ঠিক হোল কাছের এক ঐতিহাসিক শহর নারা তে যাবো. সেইমত বেরোলাম সকাল সকাল, ট্রেনে ঘন্টা খানেকের মামলা; লোকাল ট্রেন, তবে জাপানি তো, তাই সেও আমাদের শতাব্দী এক্সপ্রেসের মতই তকতকে. নারা স্টেশনে পৌঁছে একজনকে জিজ্ঞেস করলাম নারা পার্ক কতদূর, সে লোকটি তার ভাঙাচোরা ইংরেজীতে বোঝালো মাত্র মিনিট কুড়ির হাঁটা পথ; আমার যা ফিটনেস তাতে নিজের পায়ের ওপর ভরসা না করে ট্যাক্সিতেই চেপে বসলাম শেষমেশ. রাস্তার দুধারে বসন্তের সমারোহ দেখতে দেখতে পার্কের কাছাকাছি এসে গেছি, চোখে পড়ল রাস্তায়, ফুটপাথে গাদা গাদা ছাগলের পাল. জাপান যে আমাদের দেশকেও মাত দেবে ছাগলামিতে! কেমন ভড়কে গেলাম. ভাড়া মিটিয়ে রাস্তায় নেমে বুঝলাম, ছাগল নয়, এরা সব হরিণ. এমন পালে পালে দেখে ছাগল ভেবে ফেলেছিলাম আর কি. তা লোকজন দেখে মোটেও ভয় পায়না তারা, দিব্যি এগিয়ে এসে হাত থেকে খাবার খায়; তাদের খাওয়ানোর জন্যে খাবার কিনতে পাওয়া যাচ্ছে অনেকগুলো ঠেলাগাড়িতে. বুঝলাম, হরিণ ও এখানে একটা ইন্ডাস্ট্রি, ট্যুরিস্টদের খাওয়ানোর হিড়িকে পাশের জংগলের যাবতীয় চারপেয়ে পার্কে এসে জুটেছে, মাঠ ভর্তি ঘাসে তাদের কোনো আগ্রহ নেই; বিনা পরিশ্রমে খেতে পেলে আবার চরে খাওয়া কেন! 

নারা পার্কের পাশে বিখ্যাত টোডাই জি মন্দির, আমরা প্রথমে সেখানে গেলাম, নবম শতাব্দীর অনুপম স্থাপত্য, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কাঠের ইমারত. তবে মূল সাততলা মন্দিরটি এখন আর নেই, তবু যা আছে সেও বিস্ময়কর. মন্দিরের গর্ভগৃহে ঢুকতে চড়তে হয় বেশকিছু খাড়াই সিঁড়ি, আমার মত অনেকেরই বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল সেখানে, তবে নধর চেহারার হরিণরা  দেখলাম সেখানেও উপস্থিত, তাদের তো আর আমার মত হাঁটুর সমস্যা নেই! 

যাহোক, ভগবান দর্শনের পরে, ছবিতোলা ও ডান্ডা বাগিয়ে সেল্ফি তোলার মত অবশ্য কর্তব্য পালন করতে করতে বেশ হাঁপিয়ে পড়েছি, তাই বসলাম গিয়ে মন্দিরের দালানে. সেখানে বসে আছি, হঠাৎ কর্তা ঝটকা মেরে উঠে দাঁড়ালেন, 'এই ব্যাটা আমার জ্যাকেট চিবোচ্ছিল', একটা গোদা হরিণকে দেখিয়ে বলে উঠলেন তিনি. সেই গোদা এখানে সুবিধে করতে না পেরে এগোল কাছেই বসা এক মধ্য বয়সী শ্বেতাঙ্গীনীর দিকে. তাঁর কাছে একটা খাবার প্যাকেট ছিল, ভাবলাম বুঝি সেটাই লক্ষ্যবস্তু. ও হরি, প্যাকেট নয়, মহিলার শার্টটাই বাবাজীর বেশী মনে ধরেছে, শেষকালে সঙ্গের খাবার ঘুষ দিয়ে মহিলা কোনক্রমে বস্ত্রহরণ ঠেকালেন. 
এ আবার কেমনতর ব্যাবহার? ভাল ভাল খাবার খেয়ে কি অগ্নিমান্দ্য ঘটেছে, তাই জামাকাপড় চিবিয়ে মুখশুধ্যি করা? ছোটবেলায়, আমাদের পাড়াতে একটা গরু চরে বেড়াতো, সে চটি, গামছা এমনকি সাবান পর্যন্ত চেবাতো মনের সুখে,কি জানি এও সেরকম কিনা!

তবে হরিণের ব্যাদরামোর এখানেই শেষ নয়, পার্কের মাঝখানে ছাউনি ঘেরা বসার জায়গায় বসে আছে বেশ কিছু ট্যুরিস্ট, আমরাও দুজন দুটো আইসক্রিম কিনে সদ্য এককোনে বসেছি. হঠাৎ একটা গোদা শিং বাগিয়ে তেড়ে গেলো উল্টো দিকে বসা দুই থাই তরুণীর দিকে. তারা সঙ্গের যাবতীয় খাবার, মায় জলের বোতল মাটিতে ফেলেও উদ্ধার পায়না, একগুঁয়ে ষাঁড়ের মত ব্যাটা লেগে রইল ওদের সাথে . ওরা নাকের জলে চোখের জলে হয়ে পালিয়ে বাঁচল শেষে. এবার মহাশয় মনযোগী হলেন আমাদের প্রতি. কর্তা বুদ্ধি দিলেন, ওর দিকে তাকিও না, পাত্তা না পেলে চলে যাবে. একটু পরে তিনি নিজেই তিন লাফে বেঞ্চি ছেড়ে ছাউনির বাইরে, উপদেশ কাজে লাগেনি, হরিণ ওঁর জামার নীচে থেকে বেরিয়ে থাকা গেঞ্জি ধরে টেনেছিল. এবার সে তেড়ে এলো আমার দিকে; না জামা নয়, আমার হাতের আইস্ক্রীমটাই লক্ষ্যবস্তু. এদিকে আমি জুতো খুলে বেঞ্চিতে বসা, দৌড়ে পালাতে গেলে দামী জুতোজোড়ার মায়া ছাড়তে হয়, সদ্যকেনা চামড়ার জুতো চিবিয়ে চুয়িংগাম করে দেয় যদি! ফলে আমি আইসক্রীম সমেত হাত উর্দ্ধে তুলে নিমাইয়ের পোজে হাঁ করে চ্যাঁচাচ্ছি, আমার এই কাছা খোলা দশায় ব্যাটার উৎসাহ তুঙ্গে. এসময় আমার উদ্ধারে নামল একটু দূরে বসা একটি চীনে ছেলে, প্রথমে সে একটা হাজার ইয়েনের নোট বের করল, মন্ত্রের মত কাজ হোল তাতে, হরিণ ধেয়ে গেল তার দিকে অসীম আগ্রহে. সে হাঁ করে যেই নোট চেবাতে চেষ্টা করছে, ছেলেটি নোট পকেটে পুরেছে; আর যায় কোথায়, হরিণের নজর পকেটে. এরমধ্যে তার আরও দুটো সাথী সঙ্গ দিতে হাজির, আমার উদ্ধারে নেমে, ছেলেটি তখন কোনঠাসা. কিন্তু, এবার ছেলেটি যা করল, তাতে আরও একবার প্রমাণ হোল চীনেরা সত্যিই অদম্য. ছেলেটি বাঘের আওয়াজে ডেকে উঠল কয়েকবার, কয়েক সেকেন্ডেই ছাউনি হরিণমুক্ত. এরপর আমরা মহা আরামে আইসক্রীম শেষ করলাম; জুতোটা অবশ্য পায়ে গলিয়ে নিয়েছিলাম...... বলা তো যায় না!!

***

রবিবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১৮

দাঁড়ে দাঁড়ে দুম্!

ভিয়েতনাম বেড়াতে এসেছি আমরা কর্তা গিন্নি; আমার উদ্দেশ্য চম্পার ধ্বংসাবশেষ দেখতে যাওয়া, কর্তা চান ছুটিতে কদিন গা এলাতে, তাই সেই সাথে হ্যালং বে তে দুরাত্রির নৌযাত্রা প্রমোদ তরণীতে। নৌযাত্রায় নানান বিনোদন, তার মধ্যে একটি হোল কায়াকিং অর্থাৎ ছোট ছোট নৌকায় নিজে নিজে দাঁড় টেনে নৌকাবিহার।

সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট সেরে জাহাজের গাধা বোটে করে আমাদের নিয়ে যাওয়া হোল আলাদা একটি জায়গায়, যেখানে মাঝ সমুদ্রেই পাটাতন বানিয়ে গুচ্ছের প্লাস্টিকের হালকা নৌকা সাজিয়ে তৈরি হয়েছে কায়াকিং সেন্টার. যাওয়ার আগে বলা হয়েছিল সাথে আর এক সেট কাপড় নিতে; 'শান্তিমত দাঁড় টানলে জল ছিটবে না, তুমি দয়া করে নাচানাচি কোর না' কর্তার কথায় আস্বস্ত হলাম. বিয়ের পরে যদিও দেখিনি কখনো তবে মনে হোল উনি এব্যাপারে অভিজ্ঞ, আমার অবশ্য এটাই প্রথমবার।

যাইহোক, লাইন দিয়ে দাঁড় সংগ্রহ করলাম, কর্তা পছন্দ করে দুটো ম্যাচিং নীল রঙের দাঁড় নিলেন, দেখলাম এগুলো খুব হালকা আ্যলুমিনিয়ামের রড দিয়ে তৈরি, চালানো সহজ হবে, অতএব আমার উৎসাহ ততক্ষনে তুঙ্গে। একেকটি নৌকায় দুজন করে যাবে, সামনে পেছনে করে বসতে হবে। আমাদের পালা আসতে ব্যাবস্থাপক লোকটি জানতে চাইল, 'তোমাদের মধ্যে বেশী ভাল কে জানে? সে পেছনে বসবে'; অবশ্যই আমার পতিদেব পেছনে বসলেন, আর আমি সামনে। আমাদের আগে যারাই নৌকায় চড়েছে, দেখছিলাম প্রথম থেকেই কোন দিকে যাবে সেই হিসেবে দাঁড় টানতে শুরু করছে। আমরা একটু ফাঁকায় যাবো, চল বাঁ দিকটায় যাই', নৌকায় বসেই নির্দেশ পেলাম, সাথে সাথেই বাধ্য সৈনিকের মত প্রবল উৎসাহে দুহাত দিয়ে জলের মধ্যে মাছের ফাতনা নাড়ার স্টাইলে দাঁড় টানতে শুরু করলাম। পেছন থেকে ঠেলে দেওয়ায় নৌকাটা যেটুকু এগিয়েছিল, হঠাৎ দেখি লাট খেয়ে সেখান থেকে আবার পাটাতনের দিকেই তেড়ে যাচ্ছে, আমার শত দাঁড় ঝাপটানিতেও কোনো কাজ হচ্ছে না। ঠিক সেই মূহুর্তে এক বৃদ্ধ ব্রিটিশ দম্পতি নৌকায় বসছিলেন, আমাদের নৌকা গিয়ে গুঁতিয়ে দিলো তাদের নৌকাটাকে, ফলস্বরূপ প্রচন্ড ঘাবড়ে ভদ্রলোকের হাত থেকে ছিটকে পড়ল দাঁড়; প্রাণভয়ে আমাদের নৌকটাকে প্রবলভাবে ঠেলে দিলেন উনি। আর তাতেই বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়ে জলের স্রোতে পড়া গেল। 'তোমার আনতাবড়ি দাঁড় টানাতেই এমন হোল' খেঁকিয়ে উঠলেন পতিদেব। 'আরে তিনশ বছর ধরে ওরা আমাদের গুঁতিয়েছে, আর এখন এমন দুএকটা ছোটখাটো গুঁতো মারা তো আমাদের জন্মসিদ্ধ অধিকার, ওতে দোষ হয়নি' আমি সান্ত্বনা দিলাম।

জলের স্রোতে তো পড়া গেল, কিন্তু প্রাণপন দাঁড় টেনেও দেখি আমাদের নৌকা আর নড়ে না। বাকিদের তরতর করে এগিয়ে যেতে দেখে, 'জোরে দাঁড় টানো না' আমিচেঁচিয়ে উঠি। 'তুমি চুপ করে বসলেই এগোনো যাবে নির্দেশ এলো। আসলে আমরা দুজন দুদিকে দাঁড় চালানতেই ওই গোলমাল; এদিকে জল ছিটে এরিমধ্যে আমার জামাকাপড় একশা, বাধ্য হয়ে আমি ক্ষান্ত দিলাম। এরপর দেখি নৌকটা ডানদিকে চলেছে, 'বাঁদিকে যাবো বলছিলে না?', 'এদিকটাও চলবে জবাব এলো, বুঝলাম ভাল নাবিকের হাতেই পড়েছি। এভাবেই চলছিলাম বেশ, হঠাৎ আর একটা বোট সামনে এসে পড়ল, বা বলা যায় আমরাই ওদের সামনে গিয়ে পড়লাম। ওরা পাশ কাটাতে চেষ্টা করছে, এদিকে আমাদের বোট ক্যাপ্টেনের যাবতীয় কাপ্তেনি ব্যার্থ করে ওদের দিকেই ধেয়ে গেল। আমি ভ্যাবাচাকা খেয়ে চক্রব্যূহে রথের চাকা হাতে অভিমন্যুর স্টাইলে আমার হাতের দাঁড়টাকে শূণ্যে ঘোরাতে শুরু করেছি, ওদিকের নৌকোয় সামনে বসা পুতুল পুতুল চেহারার চৈনিক তরুণীর চিলচিৎকারে শান্ত পরিবেশ উত্তাল। ধাক্কা আটকানো গেলনা, তরুনীর পেছনে বসা চেংগিস খাঁয়ের রক্তচক্ষু আমার রক্ত হিম করে দিল। 'বলি করছ টা কি?' বিরক্ত হয়ে পেছন ফিরে দেখি বাঁ কাঁধ চেপে ধরে বসে আছেন ক্যাপ্টেন. 'তোমার দাঁড়ের বারি খেয়ে আমি কি কিছু করার অবস্থায় আছি?' জবাব এল। এসব গন্ডগোলে উপকার হল এই যে আশেপাশের বোটগুলো আমাদের থেকে দূরে যেদিকে পারল ছিটকে গেল, ফলে আমরা একেবারে নির্জন পরিবেশে ভেসে বেড়াতে লাগলাম।

সময় শেষ হয়ে আসছে, এবার ফেরার পালা; কিন্তু ফিরব কি করে জানা নেই। 'এখানেই চুপ করে এঁটে থাকি, ওরা নিজেরাই ঘেঁটি ধরে নিয়ে যাবে তাহলে' আমি পরামর্শ দেবার চেষ্টা করি। 'তোমাকে নিয়ে বেরোলেই যত অনর্থ' কর্তা খেঁকিয়ে উঠে আত্মসম্মান রক্ষা করলেন। এতক্ষনে আমাদের গাইড হাত নেড়ে আমাদের ফিরতে বলছে দূর থেকে। আমি দেখলাম ক্যাপ্টেনের কম্ম নয় আমাকেই করতে হবে কিছু। আমিও হাত নেড়ে বোঝাতে চাইলাম ফিরতে পারছি না। মেয়েটি অবস্থা কতক আন্দাজ করে কোন দিকে দাঁড় বাইতে হবে হাত নেড়ে দেখাতে শুরু করল, এবার কর্তাকে হাঁকিয়ে আমিই দায়িত্ব নিলাম দাঁড় টানার। মেয়েটির ইশারা লক্ষ্য করে হাঁচোড় পাঁচোড় করে ফাতনা নেড়ে পাটাতনের কাছাকাছি পৌঁছতে, ব্যাবস্থাপক বোটের দড়ি ধরে টেনে বাকিটা সামলে নিল। পতিদেব গম্ভীর মুখে আগে নামলেন, নামলাম আমিও, তবে নামতে গিয়ে হাতের দাঁড় গিয়ে ঝাপটা মারল ব্যাবস্থাপকের পশ্চাতে।

আমাদের নৌকাবিহার চিত্তাকর্ষক না হলেও বেশ লোমহর্ষক হয়েছিল (আমাদের নয়, অন্যদের জন্যে) একথা মানতেই হবে; এরপর বাকি বেলা দুজনের মধ্যে কথা বন্ধ ছিল বলাই বাহুল্য।

***
©1918 ananyapal ALL RIGHTS RESERVED


মঙ্গলবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১৭

একটি রূপকথা

সে অনেক কাল আগের কথা, এক ছিলেন রাজা চন্দ্রকেতু, প্রকৃতির কোলে শস্য শ্যামল তাঁর রাজ্য আনন্দপুর রাজ্যে কোনও কিছুরই অভাব নেই, প্রজারা সুখী, খুশী রাজকর্মচারীরাও রাজা মশাই বড় ভালো মানুষ, পরের সুখেই তাঁর আনন্দ তবু এর মাঝেই রয়েছে একটা ছোট্ট অস্বস্তি; রাজা যুবক, দেখতে শুনতেও ভালই, কিন্তু তাঁর গায়ের রঙ বেজায় কালো এই রঙ নিয়ে তাঁর মনে যত সংশয়;  কালো রাজা না জানি কত হাসির পাত্র সংশয় এমন যে রাজ প্রাসাদে না আছে কোনও আয়না, না কেউ পরে কালো রঙের কাপড়; এমনকি, রাজার সামনে মন্ত্রী, আমলা কেউ কালো কথাটাও ব্যবহার করে না পাছে রাজা দুঃখ পান এইত সেদিন রাজদরবারে সভাকবি সুর করে ধরেছেন তাঁর নতুন কবিতা,-

‘আমার মন প্রাণ সব চুরি গেছে আজ,
আমি গোয়ালিনী অবলা;
শ্যাম নাম জপী সারা দিনমান,     
চুরি করে কোথায় পালালে ‘শালা’!’

গান শুনে রাজা মশাই ভ্যাবাচ্যাকা, কবির মুখ কাঁচুমাচু; আর বাকি পারিষদের ঠোঁটে মুচকি হাসি আসলে কবিবর লিখেছিলেন কোথায় পালালে কালা কিন্তু গাইতে গিয়ে তড়িঘড়ি ভুল শোধরাতে শেষে শ্বশুর পুত্রকে স্মরণ

এতো গেল রাজসভার কথা, রাজ্যের বাইরে যেতেও রাজার ভারি সঙ্কোচ কদিন আগে প্রতিবেশী রাজ্য হুতোমপুরের রাজকন্যের স্বয়ম্বরের এলো নেমন্তন্ন; মেয়ের বাপ কতো বিনয় করে চিঠি পাঠালেন; সুশীল, ধনবান, তার ওপরে একটাও বিয়ে হয়নি এখনও, এমন জামাই পেতে কোন রাজাই না চান! কিন্তু তাতে কি, রাজা চন্দ্রকেতু অম্লশূলের বাহানায় নেমন্তন্ন ফেরত দিলেন; সুন্দরী রাজকন্নে, এতো রাজার মাঝখানে যদি কালো মুখ দেখে ঠোঁট বেঁকায়!

দিন যতো যায় মন্ত্রীরা চিন্তায় পরেন, রাজ্যে একজন রানীর প্রয়োজন নতুবা বংশলোপের সম্ভাবনা অবস্থায় রাজবয়স্য অনেক মাথা চুলকে, নস্যি সেবন করে সকাল সন্ধ্যে তামুক ফুঁকে একটা বুদ্ধি বের করলেন একদিন রাজাকে একা পেয়ে কথাটা পেড়েই ফেললেন, ‘আমি বলি কি মহারাজ, রাজকন্যেতে কাজ নেই আপনি বরং বেশ একটি সাদামাটা দেখে রানী আনুন ঘরে পার্বতী বিনে ভোলানাথকে কি মানায়? তোমার বক্তব্যটা কি হে ঘণ্টেশ্বর? একটু সোজা কথায় বল আজ্ঞে, আমাদের প্রধান্মন্ত্রীমশাই; তাঁর ধরুন গিয়ে মা ষষ্ঠীর কৃপায় গণ্ডা খানেক কন্যা, আর চেহারাপত্র তাদের বাপের মতই হেঁ হেঁ অতএব হবু স্বামীর চেহারা নিয়ে তাদের কোনও মাথাব্যাথা হবেই না (প্রসঙ্গতঃ প্রধানমন্ত্রী দেবদূত বর্মাকে তাঁর চেহারার কারনে আড়ালে লোকে যমদূত বলে ডাকে) কথাটা শুনে রাজার চোখের দৃষ্টি ঘন হয়ে এলো, আমি বোধহয় এখন সকলের দয়ার পাত্র তাই না? সেকি মহারাজ, না না! ঘণ্টেশ্বর লজ্জা পেয়ে পালাতে পথ পেলেন না

***

এক চৈতালি পূর্ণিমার সন্ধ্যেয় রাজা বিশ্রাম করছেন তাঁর রম্যদ্দানে; যূথী-মালতীর গন্ধে চারিদিক মাতোয়ারা, দখিনা বাতাসে শীতলতার আভাস হঠাৎ ভারি মিষ্টি নারীকণ্ঠের গান ভেসে এলো কিছু দূর থেকে, এতো গান নয় যেন সুরের মূর্ছনা চন্দ্রকেতু মন্ত্রমুগ্ধের মত এগিয়ে গেলেন গান লক্ষ করে বাগানের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে একটি নালা, নালার ওপর কিছু দূরে দূরে বাঁধা আছে মনোরম কাঠের পুল, আর তার চারপাশে নানান ফুলের গাছ এমনই একটি পুলের ধারে বকুল গাছের নীচে বসে আছে এক পরমা সুন্দরী মেয়ে; আকাশের চাঁদ হার মেনেছে তার  মুখশ্রীর লালিত্যে, সোনার বরণ মেয়ের রঙের ঔজ্জ্বল্যে জোৎস্নাও ম্লান। রাজা খানিক অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন রূপসীর দিকে, তারপর হঠাৎ সঙ্কুচিত হয়ে পরলেন নিজের কারনে তিনি ফিরেই যাচ্ছিলেন নিঃশব্দে, কিন্তু গানের কথা তাঁকে আটকাল

‘শ্রীমতী ভোলে শাসন বারণ কানুর দেখা পেলে -
ফুল ভোলে তার রূপের গুমোর ভোমরা কাছে এলে
কালো আঁখি ঢলঢল বাড়ায় মুখের শোভা –
চাঁদের আলোয় কালো বরণ বড়ই মনোলোভা।'

গান কি তাঁকেই শুনিয়ে গাইছে মেয়ে? একি কোনও ছলনা না মনের ভুল? এতো সব ভাবনার মাঝেই সে মেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে সামনে, হাতে তার বকুল ফুলের মালা

‘কালো-সাদা, রাত-দিন; একে মধ্যে অন্যে লীন  
আমার আলো ফুটবে কি গো তোমার আঁধার বিন?’

মালা দিয়ে রাজাকে বরণ করে নেয় দেবদুত বর্মার একমাত্র রূপবতী গুণবতী মেয়ে কাঞ্চনমালা; ঘণ্টেশ্বরকে উশ্কে রাজার কাছে পাঠনোর বুদ্ধি সেই দিয়েছিল তার বাবাকে   
এরপর ধুমধাম করে রাজার বিয়ে হল, আমার কথাটি ফুরলনোটে গাছটি মুড়ল

***