সে অনেক কাল আগের কথা, এক ছিলেন রাজা চন্দ্রকেতু, প্রকৃতির কোলে শস্য শ্যামল তাঁর রাজ্য আনন্দপুর। রাজ্যে কোনও কিছুরই অভাব নেই, প্রজারা সুখী, খুশী রাজকর্মচারীরাও। রাজা মশাই বড় ভালো মানুষ, পরের সুখেই তাঁর আনন্দ। তবু এর মাঝেই রয়েছে একটা ছোট্ট অস্বস্তি; রাজা যুবক, দেখতে শুনতেও ভালই, কিন্তু তাঁর গায়ের রঙ বেজায় কালো। এই রঙ নিয়ে তাঁর মনে যত সংশয়; কালো রাজা না জানি কত হাসির পাত্র। সংশয় এমন যে রাজ প্রাসাদে না আছে কোনও আয়না, না কেউ পরে কালো রঙের কাপড়; এমনকি, রাজার সামনে মন্ত্রী, আমলা কেউ ‘কালো’ কথাটাও ব্যবহার করে না পাছে রাজা দুঃখ পান। এইত সেদিন রাজদরবারে সভাকবি সুর করে ধরেছেন তাঁর নতুন কবিতা,-
‘আমার
মন প্রাণ সব চুরি গেছে আজ,
আমি
গোয়ালিনী অবলা;
শ্যাম
নাম জপী সারা দিনমান,
চুরি
করে কোথায় পালালে ‘শালা’!’
গান শুনে রাজা মশাই ভ্যাবাচ্যাকা, কবির মুখ কাঁচুমাচু; আর বাকি পারিষদের ঠোঁটে মুচকি হাসি । আসলে কবিবর লিখেছিলেন ‘কোথায় পালালে কালা’ কিন্তু গাইতে গিয়ে তড়িঘড়ি ভুল শোধরাতে শেষে শ্বশুর পুত্রকে স্মরণ।
এতো গেল রাজসভার কথা, রাজ্যের বাইরে যেতেও রাজার ভারি সঙ্কোচ। কদিন আগে প্রতিবেশী রাজ্য হুতোমপুরের রাজকন্যের স্বয়ম্বরের এলো নেমন্তন্ন; মেয়ের বাপ কতো বিনয় করে চিঠি পাঠালেন; সুশীল, ধনবান, তার ওপরে একটাও বিয়ে হয়নি এখনও, এমন জামাই পেতে কোন রাজাই না চান! কিন্তু তাতে কি, রাজা চন্দ্রকেতু অম্লশূলের বাহানায় নেমন্তন্ন ফেরত দিলেন; সুন্দরী রাজকন্নে, এতো রাজার মাঝখানে যদি কালো মুখ দেখে ঠোঁট বেঁকায়!
দিন যতো যায় মন্ত্রীরা চিন্তায় পরেন, রাজ্যে একজন রানীর প্রয়োজন নতুবা বংশলোপের সম্ভাবনা। এ অবস্থায় রাজবয়স্য অনেক মাথা চুলকে, নস্যি সেবন করে সকাল সন্ধ্যে তামুক ফুঁকে একটা বুদ্ধি বের করলেন। একদিন রাজাকে একা পেয়ে কথাটা পেড়েই ফেললেন, ‘আমি বলি কি মহারাজ, রাজকন্যেতে কাজ নেই আপনি বরং বেশ একটি সাদামাটা দেখে রানী আনুন ঘরে। পার্বতী বিনে ভোলানাথকে কি মানায়?’ ‘তোমার বক্তব্যটা কি হে ঘণ্টেশ্বর? একটু সোজা কথায় বল’। ‘আজ্ঞে, আমাদের প্রধান্মন্ত্রীমশাই; তাঁর ধরুন গিয়ে মা ষষ্ঠীর কৃপায় গণ্ডা খানেক কন্যা, আর চেহারাপত্র তাদের বাপের মতই। হেঁ হেঁ অতএব হবু স্বামীর চেহারা নিয়ে তাদের কোনও মাথাব্যাথা হবেই না (প্রসঙ্গতঃ প্রধানমন্ত্রী দেবদূত বর্মাকে তাঁর চেহারার কারনে আড়ালে লোকে যমদূত বলে ডাকে)’। কথাটা শুনে রাজার চোখের দৃষ্টি ঘন হয়ে এলো, ‘আমি বোধহয় এখন সকলের দয়ার পাত্র তাই না?’ ‘সেকি মহারাজ, না না!’ ঘণ্টেশ্বর লজ্জা পেয়ে পালাতে পথ পেলেন না ।
***
এক চৈতালি পূর্ণিমার সন্ধ্যেয় রাজা বিশ্রাম করছেন তাঁর রম্যদ্দানে; যূথী-মালতীর গন্ধে চারিদিক মাতোয়ারা, দখিনা বাতাসে শীতলতার আভাস। হঠাৎ ভারি মিষ্টি নারীকণ্ঠের গান ভেসে এলো কিছু দূর থেকে, এতো গান নয় যেন সুরের মূর্ছনা। চন্দ্রকেতু মন্ত্রমুগ্ধের মত এগিয়ে গেলেন গান লক্ষ করে। বাগানের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে একটি নালা, নালার ওপর কিছু দূরে দূরে বাঁধা আছে মনোরম কাঠের পুল, আর তার চারপাশে নানান ফুলের গাছ। এমনই একটি পুলের ধারে বকুল গাছের নীচে বসে আছে এক পরমা সুন্দরী মেয়ে; আকাশের চাঁদ হার মেনেছে তার মুখশ্রীর লালিত্যে, সোনার বরণ মেয়ের রঙের ঔজ্জ্বল্যে জোৎস্নাও ম্লান। রাজা খানিক অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন রূপসীর দিকে, তারপর হঠাৎ সঙ্কুচিত হয়ে পরলেন নিজের কারনে। তিনি ফিরেই যাচ্ছিলেন নিঃশব্দে, কিন্তু গানের কথা তাঁকে আটকাল।
‘শ্রীমতী ভোলে শাসন বারণ কানুর দেখা পেলে -
ফুল ভোলে তার রূপের গুমোর ভোমরা কাছে এলে।
কালো আঁখি ঢলঢল বাড়ায় মুখের শোভা –
চাঁদের আলোয় কালো বরণ বড়ই মনোলোভা।'
গান কি তাঁকেই শুনিয়ে গাইছে ও মেয়ে? একি কোনও ছলনা না মনের ভুল? এতো সব ভাবনার মাঝেই সে মেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে সামনে, হাতে তার বকুল ফুলের মালা ।
‘কালো-সাদা, রাত-দিন; একে মধ্যে অন্যে লীন।
আমার আলো ফুটবে কি গো তোমার আঁধার বিন?’
মালা দিয়ে রাজাকে বরণ করে নেয় দেবদুত বর্মার একমাত্র রূপবতী গুণবতী মেয়ে কাঞ্চনমালা; ঘণ্টেশ্বরকে উশ্কে রাজার কাছে পাঠনোর বুদ্ধি সেই দিয়েছিল তার বাবাকে ।
এরপর ধুমধাম করে রাজার বিয়ে হল, আমার কথাটি ফুরল – নোটে গাছটি মুড়ল ।
***
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন