শীতের ছুটিতে কোলকাতা গেছি কদিনের
জন্যে, এক বন্ধু ধরলেন শান্তিনিকেতন চলো পৌষমেলায়। আঁতকে উঠে বললাম, সেখানে তো
মানুষের ঢল, থাকার জায়গা পাওয়া দায়। জানা গেলো বন্ধু সম্প্রতি পৌষমেলা প্রাঙ্গনের
খুব কাছেই গুরুপল্লীতে একটি মনোরম বাংলো করেছেন; নিমন্ত্রণ সেই বাড়িতে থাকার।
অতএব,নির্ভাবনায় বেরিয়ে পড়লাম গাড়ী নিয়ে ২৫শে ডিসেম্বর ভোরে। প্রসঙ্গত, বাংলা
ক্যালেন্ডারের ৭ই পৌষ থেকে তিনদিন পৌষমেলা আয়োজিত হয় শান্তিনিকেতনে, যার শুরু
হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের আমলে ব্রাহ্মমন্দির প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে। উপলক্ষ যাই হোক,
কবিগুরুর উদ্দেশ্য ছিলো এই মেলার মাধ্যমে স্থানীয় প্রান্তিক মানুষদের (প্রধানত
সাঁওতাল) হাতের কাজ শহরবাসীর কাছে তুলে ধরা; সেই প্রথার ব্যাতিক্রম হয়নি আজও।
কোলকাতা থেকে গাড়ীতে শান্তিনিকেতন তিন ঘন্টার পথ, পথে ল্যাংচা মিষ্টির জন্যে খ্যাত
শক্তিগড়ে কচুড়ি ও ল্যাংচা সহযোগে শীতের প্রাতরাশ। বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ
শান্তিনিকেতন পৌঁছে, সেই চেনা লাল মাটির পথ, ফুলের বাগান ঘেরা ছোট ছোট বাংলোবাড়ী
দেখে মনটা জুড়িয়ে গেলো; আশ্রম চত্ত্বরের পুরোন সব গাছ আর তার বাঁধানো বেদীমূল আজও
যেন কবিগুরুর স্বপ্নের আশ্রম জীবনেরই আভাষ দেয়, সভ্যতার ছোঁয়ায় আঁচড় লাগেনি তার
নির্মলতায়। বন্ধুর বাংলোয় পৌঁছে দেখলাম, ফুলে ফলে ভরা এক স্বর্গরাজ্য, রোদ মাখা
তার দক্ষিণের বারান্দাটিতে বসেই কাটিয়ে দেওয়া যায় অনন্তকাল। দুপুরে খাবার
উদ্দেশ্যে আমরা গেলাম বিখ্যাত বনলক্ষী রেস্তোরাঁর ঠিক উল্টো দিকে ‘বড়িশালের
রান্নাঘরে’। নামের মাহাত্য বজায় রেখে সেখানকার শুক্তো, ডাল, কপির ডালনা, পাবদা মাছ
ও গলদা চিংড়ি ছিল একেবারে অমৃতসম।
খাওয়া দাওয়া সেরে বাড়ী এসে খানিক বিশ্রাম নিয়ে
বেরিয়ে পরলাম পৌষমেলার উদ্দেশ্যে, দূরত্ব সামান্যই তাই পায়ে হেঁটেই যাওয়া গেল। তখনও
সন্ধ্যে নামেনি, তবু মানুষের ঢল রাস্তায়, লক্ষ্য সকলেরই মেলা প্রাঙ্গণ; বাহারি
সাজে আর চোখে মুখের উত্তেজনায় আবালবৃদ্ধ সেদিন উৎসবের ঘোরে মাতোয়ারা। মেলায় ঢোকার
মুখ থেকেই শুরু হয়ে গেছে নানান দোকান, শুরুতেই ছোটদের খেলনা আর মেয়েদের সাজের
জিনিষের পশরা সাজিয়ে বসে আছেন স্থানীয় মানুষ; বুঝলাম মেলার মুখ্য ক্রেতা মহিলা ও
শিশুরাই। তারপর যত এগোই পরপর অজস্র দোকান, কোথাও বা রকমারি পিঠে, কোথাও তেলেভাজা ও
অন্যান্য মুখোরোচক; কোথাও ঘর সাজানোর জিনিষ তো কোথাও রান্নাঘরের রকমারি। পশরা
বসেছে কাঁথা ও বাটিক কাজের, আছে খাদির দোকান, শীতের পোশাক, কম্বল, শতরঞ্চিও বাদ
নেই। গরম গরম আসকে পিঠে খেতে খেতে গিয়ে দাঁড়ালাম বাউল গানের আসরে, প্রায় শখানেক
বাউল সেখানে মঞ্চ আলো করে বসে আছেন, সামনে কাতারে কাতারে শ্রোতা সামিয়ানার নীচে
শতরঞ্চিতে বসে, দাঁড়িয়েও গান শুনছেন বহু মানুষ শীতের পরোয়া না করেই। মাথার ওপর
পূর্ণচন্দ্র, মঞ্চেও জোছনা মাখামাখি; উদ্দাত্ত কন্ঠের গান, সঙ্গতে শুধু একতারা আর
বাঁশী; শুনতে শুনতে রাত কখন গভীর হয়েছে বুঝতেই পারিনি। একসময়, বন্ধুর ডাকে চেতনা
ফিরল, বুঝলাম এবার ফেরা উচিৎ। হাতে একরাশ কড়ি ও কাঠের গয়না, আর মনের ভেতর উদাসী
ভাললাগা নিয়ে আস্তানায় ফিরেছিলাম সেদিন।
নানা রঙের মেলা |
হাতের কাজে ব্যস্ত দোকানী |
বাউল গানের আসর |
পরদিন খোয়াইয়ের সূর্যোদয় যেন নতুন করে
বাউলের সুরে বেঁধেদিল মনটাকে; দিনের বেলা আবার ছুটলাম মেলায়। সকালের ঝলমলে আলোয় গতরাতের মায়াবী
প্রাঙ্গণ যেন চঞ্চলা কিশোরী, আকর্ষণ তারও কিছু কম নয়। এক চা ওয়ালা ভাইকে জিজ্ঞেস
করে জানলাম, তিনি থাকেন অজয়ের পাড়ে; ‘মেলা শেষে কি করবেন?’ আমার প্রশ্নে হেসে
জানালেন, ‘যাবো জয়দেবের মেলায়’। বুঝলাম মনটা তাঁরও বাউল, মেলাতেই যার বাস। দুপুর
বেলা ফিরে চললাম কোলকাতায়, সারাটা রাস্তা মনের একটা কোনায় লেগে রইলো মন খারাপের
সুর, আর একটা কোনা অনেক প্রাপ্তির আনন্দে টইটুম্বুর।
গেরুয়া সকাল |
ভোরের আলোয় খোয়াই |
***
apoorbo
উত্তরমুছুনSundor. Vividly described.
উত্তরমুছুনOsadharon!
উত্তরমুছুনOsadharon!
উত্তরমুছুনভাল....তবে মন যে আরও চায়.........আরেকটু দীর্ঘ হলে আরও উপভোগ্য হয়...দীর্ঘ করতে ভ্রমণসঙ্গীদের ব্যক্তিগত বর্ণনা, প্রতিবেশ...পরিচ্ছদ...ভাল লাগা না লাগা এসব উঠে আসতে পারে.....
উত্তরমুছুন