নিবিড় বনছায়ার অমোঘ নিস্তব্ধতা ভারি
প্রাণবন্ত,
পাতা ঝড়ার অস্পষ্ট শব্দ যেন প্রকৃতির
হৃদস্পন্দন,
বিরামহীন নৈঃশব্দে অদ্ভুত শান্তির নিমগ্নতা;
আলিঙ্গনবদ্ধ গাছের সাড়ির ফাঁকে জেগে
আছে গলিপথ,
আধো অন্ধকারে, আবছায়া;
সেই অচেনা পথের বাঁকে খুঁজে পাই আমার ‘আমি’ কে,
হারিয়েছিলাম যাকে চেনা জীবনের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে।
সপ্তাহান্তের ছুটিতে ঢাকার হট্টগোল থেকে বিরাম নিতে ঠিক হোল
যাব শ্রীমঙ্গল। সিলেটের কাছাকাছি চা বাগানের দেশ এই জায়গাটি মাত্র ঘন্টা চারেকের রাস্তা
গাড়ীতে; অতএব ভোর থাকতেই বেরিয়ে পরা গেলো। বসন্ত সমাগত প্রায়, তবু আঁধার করা কুয়াশায়
কয়েক হাত দূরের জিনিষও অদৃশ্য; তাই যাত্রার শুরুটা বেশ রোমহর্ষকই হোল বলতে হয়। এভাবে
কুমিল্যা পার হয়ে হাইওয়ের ধারে ‘উজান বাটী’ ধাবায় নিলাম জলখাবারের বিরতি; সুস্বাদু
ও পরিচ্ছন্ন ব্যবস্থায় খাওয়া দাওয়া হোল এলাহি এবং বিরতি একটু বেশীই লম্বা। ধাবার ভেতরেই
এক মজাদার খাদি দোকান, তাতে কাঁথা কাজের চাদর, বাটিকের শাড়ী, খদ্দরের পোশাক এসবের সাশ্রয়ী
সম্ভার; সেখানে বেশ খানিক শপিং করে ফেললাম। দ্বিতীয় দফার যাত্রায়, পথের দুধারে যতদূর
চোখ যায় ঘন সবুজের খেলা দেখতে দেখতে গন্তব্যে পৌঁছানোর ইচ্ছেটাই ক্রমে চলে যাচ্ছিল,
মন ভালো করা এই পথের শেষ যেন না হয় এটাই ভাবতে শুরু করেছিলাম কখন আনমনে।
আসতে আসতে প্রকৃতির পরিবর্তিত রূপ দেখে মালুম হোল, পার্বত্য
উপত্যকার চা বাগানের দেশে এসে পড়েছি আমরা। দুপাশের ঢালু জমিতে ঘন সবুজ চা বাগান আর
মাঝে মাঝে সোনালি রবার গাছের সারি, মাঝখান দিয়ে পাহাড়ী রাস্তা কুয়াশার পাতলা চাদরে
মোড়া। একটা দুটো ঘুমন্ত শহরতলী পেরিয়ে পৌছলাম আমাদের গন্তব্য গ্র্যান্ড সুলতান রিসোর্টে।
রিসেপশনে জানালো আমরা হাজির হয়েছি সময়ের আগেই, ঘর গোছাতে সময় লাগবে কিছুটা। অতএব, লাগেজ
জমা করে বেরিয়ে পরলাম রিসোর্টের ভেতরটা ঘুরে দেখতে। বাইরে দিকের কিছুটা অংশে হোটেল
কতৃপক্ষ অনাবাসী টুরিস্টদের সময় কাটানোর ছাড়পত্র দেন; সেখানে গিয়ে দেখি নানারঙের এক
মজার হাট। পয়লা ফাগুন (বাংলাদেশের প্রেম দিবস) পালন করতে সেখানে ঝাঁকে ঝাঁকে কমবয়সী
ছেলে মেয়ে ঘুরে নয় উড়ে বেড়াচ্ছে বলাই ভালো। আমরা (আমি ও আমার কর্তা) একটু তফাতে কফিশপে
বসে তাদের লক্ষ করছি, হঠাৎ দেখি কয়েকজন যুবক হাতে ডান্ডা নিয়ে উদ্ভভ্রান্তের মত কৃত্রিম
হ্রদের চারপাশে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, মনে মনে শঙ্কিত হলাম, এ আবার কি উৎপাত! ‘আরে ডান্ডা
কোথায়, সেলফি স্টিক নিয়ে ঘুরছে’ কর্তা আস্বস্ত করলেন; বাহারে পরিমন্ডলে নিজের ছবি তুলে
ফেসবুকে দেবার চাপ তো কম নয়!
এই পথ যদি না শেষ হয়... |
সবুজের দেশে |
রবার গাছের সাড়ি |
হোটেলেও সবুজের ঘেরাটোপ |
পথের বাঁকে |
টিলার ওপর শান্তির নীড় |
পরদিন প্রাতঃরাশ সেরে আমরা গেলাম লাউয়াছড়া সংরক্ষিত বন দেখতে, কয়েক কিলমিটারের মধ্যেই তার অবস্থান। সেখানে বনের অন্দরে সবুজের সমারোহ শান্ত সমাহিত, পায়চলা পথে হাটতে হাটতে চমকে উঠি পাতা
ঝরার শিরশিরে শব্দে। পাখিদের কলতান কোথাও জাগিয়ে তোলে সুরের
লহরী, প্রজাপতির ঝাঁক খেলে বেড়ায় কোথাও আপন খেয়ালে। বনের পথে কিছুটা সময় কাটিয়ে আমাদের সারথীর উৎসাহে রওনা দিই মাধবপুর
চা বাগানের দিকে। একে ওকে জিজ্ঞাসা করে পৌঁছুতে লেগে
গেলো খানিকটা সময়, ফলে দেখা হয়ে গেলো কিছূ গ্রামের বসতি ও চা বাগানের জীবনযাত্রা। সেদিনটা ছিল সরস্বতী পূজোর পরেরদিন, বাগানের কচিকাচাদের প্যান্ডেল ঘিরে
উৎসাহ দেখে মনে পড়ে যাচ্ছিল নিজের ছোটবেলা। মাধবপুর বা ন্যাশনাল টি কম্পানীর চা
বাগানে আছে পাহাড় ঘেরা ভারি সুন্দর একটি কৃত্রিম হ্রদ, ব্রিটিশ মালিকানা কালীন সময়ে সেটি তৈরী
হয়েছিল বাগানে জল সরবরাহের জন্যে। সেই লেকের জলে থরে থরে ফুটে আছে দেখলাম
বেগুনী রঙের শালুক, আমার অনভ্যস্ত চোখে সে যেন রূপকথার দুধসায়রে নীলপদ্মের বন; যেখানে লুকিয়ে আছেন কুঁচবরণ রাজকন্যে
ভিনদেশী রাজপুত্রের অপেক্ষায়।
বনের একপাশে রেললাইন |
বনপথে |
যেখানে প্রজাপতি, সেখানে আছে সেও |
দোয়েল বলে 'টুকি' |
বক তপস্বী |
দুধসায়র |
রাজকন্যে আছেন কি? |
মনহরিণী |
অবশেষে পড়ন্ত বেলায় হোটেলে ফিরে ঘরে ঢুকে দেখি রাখা আছে ভ্যালেন্টাইন্স
ডে র উপলক্ষে ছোট্ট একটি হার্ট শেপের কেক। বসন্তের আবির রাঙা বিকেলে, ভালবাসা দিবসের
গোলাপী হৃদয় পেয়ে সেদিন মন্দ লাগেনি একথা স্বীকার করতে বাধা নেই।
সব মিলিয়ে দুটো দিন যেন স্বপ্নের ঘোরেই কেটে গেলো, পরদিন সকালে
ঢাকার পথে পাড়ি দিতে দিতে মনে হোল ওই সবুজের সমারোহের ছোঁয়া রাঙিয়ে দিয়েছে আমার শহুরে
মনটাকেও কখন অজান্তে; আর সেটাই এই ছুটির অভিযানে আমার বড় পাওনা।
***
©1916 ananyapal ALL RIGHTS
RESERVED
All photographs are copyrighted by Dilip Pal ©1916 dilippal ALL RIGHTS RESERVED
All photographs are copyrighted by Dilip Pal ©1916 dilippal ALL RIGHTS RESERVED