কবিতা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
কবিতা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

শুক্রবার, ২৫ আগস্ট, ২০১৭

ছাড়া কি যায়?

আমার ঢাকার বাড়ির বারান্দায় আলো আঁধারির ছায়া ফেলে ঝুঁকে আছে যে গাছটি,
বহুকালের চেনা বন্ধুর মতই তার উপস্থিতি , আমার এই তিনবছর ব্যাপী প্রবাস জীবনে;
নাম জানতে চাইনি কখনও, নামে কি বা আসে যায়?
গ্রীষ্মের দখিনা বাতাসে তার পাতায় ঢেউ, আমাকে ছুঁয়ে যায় আলতো আলিঙ্গনে,
বাদলা দিনের একলা দুপুরে সিক্ত পরশে সে জানায়, ‘পাশেই আছি’,
মন উঁচাটন বসন্তদিনে ডালপালা দুলিয়ে হাতছানি দেয় পরম আদরে।
আজ যাবার দিনে, তার চিকণ পাতার নরম সবুজে রয়ে যাবে আমারও একটু খানি,
ছাড়তে চাইলেই ছাড়া কি যায়?

গাছের ডালে, বারান্দার কার্নিশে নিত্য তার আনাগোনা, গলায় সাদা দাগ,
গল্পপ্রিয়, প্রতিক্রিয়াশীল এক বাঙ্গালিনী কাক;
আমার মত সেও একটি মেয়ের মা, মাতৃত্বের অনেক কিছু শিখেছি তার কাছে।
ছটফটে, চটপটে একজোড়া বুলবুলি, দূপুরের লেখালেখির মগ্নতার মাঝে,
পড়ার ঘরের কাঁচে, ঠোকর দিয়ে জানান দেয় গোপন অভিমানে,
আমারও আছি সাথে।
লক্ষ্মীমন্ত বেনেবউ কাঁচা হলুদ গা, হালকা পায়ে উড়ে বেড়ায় এডালে, ওডালে,
হোল না তো কমদিন, তবু আমার মুগ্ধতা আজও সেই প্রথম দিনের মতই।
চলে যেতে হবে সবাইকে ছেড়ে, তবু নিঃসঙ্গ দিনে আলো ছায়ার আঁকিবুঁকিতে, রয়ে যাব আমি;
ছাড়তে চাইলেই ছাড়া কি যায়?

চায়ের কাপ হাতে জানলায় বসলেই, দেখা যায় শ্যামলিমা ঘেরা বারিধারা ঝিল,
তার গহন গভীর জলে ডুব দিয়ে, কুড়িয়ে আনতে সাধ হয় জমে থাকা বহূযুগের কথা;
উজ্বল দিনে সোনা চিকচিকে ঢেউয়ে, পাল তোলে আমার সুদূর পিয়াসী মন।
ধ্যানগম্ভীর পূবের দিগন্তের গেরুয়া, ছুঁয়ে যায় আমার অন্তঃস্থল প্রতিদিন;
গোধূলির কোনে দেখা আলোয় দূরন্ত পশ্চিমী ক্যানভাস –
ধরে রাখি মনের লেন্সে ক্লান্তিহীন মুগ্ধতায়।  
আমি চলে যাব; তবু ঝিলের ঢেউ ছন্দহীন হবে না, সূর্যাস্তের রঙে আঁকা হবে নতুন কাহিনী;
শুধু আমার নিঃশ্বাস বাস্প, ভোরের শিশির হয়ে মূর্ত হবে জানলার কাঁচে;
ছাড়তে চাইলেই ছাড়া কি যায়?


***
©1917 ananyapal ALL RIGHTS RESERVED

মঙ্গলবার, ১৩ জুন, ২০১৭

আষাঢ়স্য প্রথমদিবসে

খোলা বাতায়ন পথে দখিণা বাতাস বয়ে আনে স্নিগ্ধ পরশ তন্দ্রাতুর অলস মধ্যাহ্নে,
নুয়েপড়া বৃক্ষশাখে রাঙা কিংশুক গুচ্ছ দোলে, সলজ্জ হরষে;
বুঝিবা বলতে চায় কিছু।
উদ্যান মাঝে যত্নে বাঁধানো পুষ্করিণী, শ্বেতপদ্ম ফুটে আছে তার নীল জলে,
বকুল বৃক্ষের ছায়াঘন প্রস্তর বেদিকা, ঝরা বকুলের সমারোহ সেথা,
যুথি,জাতি, মল্লিকা কুন্দফুলে উপবন, নন্দনকানন;
বাতাস মদির পুষ্প সৌরভে।

একাকী পুরুষ রয়েছেন বসে গবাক্ষ পাশে, অতিশয় কান্তিমান,
তপ্ত কাঞ্চন বর্ণ, দীর্ঘ, ঋজু দেহ, দেবতুল্য মুখশ্রী,
চোখদুটি কোমল, ভাবময়, না জানি বিভোর কোন মধুর কল্প লোকে,
উন্মুক্ত কাঁধে দৃশ্যমান উপবীত, কুঞ্চিত কেশদামে বাতাসের মৃদুস্পর্শ;
সম্মুখে রয়েছে সুসজ্জিত কাঠের পীঠিকা, সম্বৃদ্ধ লেখার সরঞ্জামে,
যুথীমাল্য ঘিরে আছে মসীধার, সুগন্ধী ধূপ জ্বলে কুলুঙ্গীতে,
তালপত্রে লিখে চলেছেন কিছু নিবিষ্ট আগ্রহে, বিদগ্ধ পুরুষ।

ক্ষণপরে থেমে যায় লেখনী,মুখ তুলে চান যুবা অন্যমনে,
দুচোখের ভাষায় অজ্ঞাত তৃষ্ণা, নীরব অভিব্যক্তি বেদনাবিধূর,
মধুময় দ্বিপ্রহরে, বসে থাকেন কবি, নিঃসঙ্গ মূরতি।
রামগিরি পর্বতে রাম-সীতার মিলন আশ্রমে, অভিশপ্ত যক্ষ,
কাটাবে দীর্ঘ বিরহকাল,
প্রণয় মাধুর্যের স্মৃতি নিষ্ঠুর দংশনে দংশাবে তিলে তিলে;
তাই কি মলিন কবির সুকুমার মুখ?
বিরহ কি শুধুই যক্ষের!
কৈলাস পর্বতে ফেলে আসা প্রেয়সী, সে কি শুধুই কল্পনা!

সিক্ত বাতাসের দমকে, শিহরণ জাগে, চোখ যায় বহির্পানে,
মধ্যাহ্নের প্রখর সূর্য উত্তাপহীন, যেন কোন জাদুমন্ত্রবলে;
উম্নুখ কেকারবে মুখর কানন।
মুগ্ধ বিস্ময়ে চেয়ে দেখেন কবি, কৃষ্ণমেঘ সবল প্রতাপে ঢেকেছে দিগন্ত,
প্রবল গর্জনে তার অগ্রীম বর্ষণ বার্তা;
দেশ দেশান্তরে বর্ষার ক্লান্তিহীন দূত, বয়ে নিয়ে যাবে আনন্দ সন্দেশ এমনই গৌরবে।
মৃদু হাসি ধরা দেয় ওষ্ঠাধরে, লেখনী সরব হয় তালপত্রে পুনর্বার,
“আষাঢ়স্য প্রথমদিবসে মেঘমাশ্লিষ্টসানুং
বপ্রক্রীড়াপরিণতগজপ্রেক্ষণীয়ং দদর্শ।।“
কবিশ্রেষ্ঠ নিমগ্ন হন কাব্যে তাঁর।

***
©2017 ananyapal ALL RIGHTS RESERVED

মঙ্গলবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

প্রণয়সাক্ষী


ভোরের নরম আলোয় অগস্ত্য তীর্থের নীল জল কাকচক্ষু,
গুহা অলিন্দে যক্ষ ও বক্ষলগ্না প্রেয়সী নবপ্রেমরসে বিভোর,
তোমার স্থাপত্য শিল্পে পেয়েছে প্রাণ রুক্ষ প্রস্তরখন্ড,
তোমার কল্পনায় আজ স্বর্গীয় যক্ষ প্রেমগাথা।

আমি দেবদাসী নিত্য আসা যাওয়া এই বিষ্ণু মন্দিরে,
অলক্ষে চেয়ে থেকেছি কতদিন, আত্মমগ্ন তুমি দেখনি ফিরে;
সেদিন বসন্ত পঞ্চমী তিথি, এমনি ভোরের আলোয় ঘুমিয়ে ছিলে গুহা মন্ডপে,
জাতি পুষ্পহার এসেছিলাম রেখে অতি চুপে  চরণে তোমার,
'দেবী উপাচারের মালাটি তোমার ভূমিতে লুটায়' -
পিছু ডেকে বলেছিলে।

'হায় শিল্পী, পাথরের বুকে নিত্য জাগাও যে প্রেম, সে কি শুধুই কল্পনা!
রূদ্ধ রেখেছ হৃদয়ের দ্বার, বসন্ত সমীর সেথা মাথা খুঁড়ে মরে' -
মৃদু তিরস্কারে বলে উঠি অভিমানে ।
'ভাল করে দেখেছ কি চেয়ে, যক্ষীণির মুখখানি অনঙ্গসেনা?
ও দুটি কালো আঁখি লাগে না কি চেনা, ওই ওষ্ঠাধর পদ্ম কোরকসম সেও কি অচেনা!'
মৃদু হাসি জেগে ওঠে তোমার ঠোঁটের কোণে,
আমি আত্মবিস্মৃত হই নতুন আবেগে,  জলে ভাসে আঁখি।

বহুযুগ পরে নব পরিচয়ে এসেছি আবার সেই পুরানো আলয়ে, 
প্রস্তরে প্রস্তরে সেথা বাজে প্রণয়ের সুর,
যক্ষী- যক্ষীণী আজো সাক্ষী হয়ে আছে আমাদের চিরমিলনের।।
***
©1917 ananyapal ALL RIGHTS RESERVED

বৃহস্পতিবার, ১৮ আগস্ট, ২০১৬

ঝুলন দোলা

সকাল সকাল ঘন হয়ে এসেছে আকাশ, বারান্দার পাশের কৃষ্ণচূড়া আদুরে বাতাসে টলমল;
ব্যস্ত পায়ে বন্ধ করছি দরজার কাঁচ – কি যে হোল,
চোখ ফেরতে পারলাম না, কাজ ফেলে বেরিয়ে এলাম।
এলোঝেলো বৃষ্টির ছিটের মায়াবী স্পর্শ মেখে,আমি বসে থাকি বিমূঢ় মুগ্ধতায়;
কোন সে মোহনিয়া সুরে বশীভূত মন আমার।
ভরা শ্রাবণ, বৃষ্টি যে নিত্যসঙ্গী, এমন কাজ ভোলানো উচাটন হয়নি তো আগে!
মনে পড়ে গেলো, আজ ঝুলন।

আবছায়া স্বপ্নের মত মনে পড়ে সেই বর্ষণ স্নাত আর্দ্র অপরাহ্ন,
গোধূলী বেলার আবির বুঝিবা কিছুটা ধুসর,ছায়াঘন মাধবী বিতান;
আনমনা মেয়েটি একা বসে, গাছে বাঁধা দোলনায়, সাথী নেই কেউ আর।
আলোগোছা বেণীতে জুঁই ফুল,কপালে সোহাগী সিঁদুর,ঘননীল শাড়ীতে যমুণার ঢেউ;
কাজল কালো তার দুটি চোখ, বড় মায়াময়।
বিয়ের পর এই প্রথম শ্রাবণে এসেছে বাড়ী, না বাড়ী তো নয় আর, বাপের বাড়ী,
আনন্দ উচ্ছ্বাসে, আদরে, খাতিরে নিটোল ছিল সারাটা দিন –
তবু কেন এই উদাসী ক্লান্তি, ফাঁক পেয়ে ছুটে আসা বাগানের প্রিয় কোণটিতে!

দূর থেকে ভেসে আসে বাঁশরীতে মারবা-র তান, সন্ধ্যে ঘনিয়ে এলো ওই,
রূপোলী জোছনা মেখে ফুলবন স্বপ্ন বাসর;
হালকা বাতাস খেলা করে কপালের ঝুরো চুলে,জমে ওঠা মুক্তাবিন্দু  ছলকায় চোখে।
দীর্ঘ ছায়া ফেলে, শান্ত পায়ে কে এসে দাঁড়ালো ওই দোলনার পাশে!
ভারি সুকুমার হাসিমাখা মুখখানি, আনন্দ মূরতী;
মৃদু দোলা দেয় সে ঝুলনায়, চমকে ফিরে চায় মেয়ে, চেয়েই থাকে বুঝিবা অনন্তকাল,
সব অভিমাণ ভেসে যায় শ্রাবণ বরিষণে; -
ঝুলন দোলায় দোলে ফেলে আসা কৈশোর, চিরন্তন প্রেমে।


***
©1916 ananyapal ALL RIGHTS RESERVED

বৃহস্পতিবার, ১১ আগস্ট, ২০১৬

কুড়োনো মাণিক

মহল্লার সবচেয়ে বড় দোকানটা সাবির মিঞার, শাড়ীর সম্ভার সেখানে চোখ ধাঁধানো;
ছেলেটার সাথে আমার সেখানেই দেখা, ফুফার পাশে পাশে শাড়ী দেখায় –
লক্ষ্য করেছি দাম নিয়ে মতবিরোধে, আমার হয়ে সুপারিশ করে হামেশাই;
‘ছেলেমানুষ, ঝানু দোকানদার তো নয়’ স্নেহ অনুভব করি মনে মনে।
সেবার বন্ধু এসেছেন কোলকাতা থেকে, জামদানী পাড়ায় যেতেই হয় অতএব,
এমন কপাল, সাবির মিঞা গেছেন মহাজনের কাছে, দোকান বন্ধ;
ভাবছি দাঁড়িয়ে কি করি, বান্ধবীও আশাহত,
‘আপা আসেন ইদিকে’ পাশের খুপরি দোকানটা থেকে উঁকি দিলো ছেলেটার হাসি মুখ।
 একটু ইতস্তত করে এগোই,’এটা কার দোকান?’
‘আল্লাহ্‌র দোয়ায় আমারই’ ছেলেটার সলজ্জ উত্তর, সেইসঙ্গে এগিয়ে দেওয়া ছাপা কার্ডটা থেকে প্রথম জানলাম ওর নাম দিলাবার।

‘শাড়ী দেখাতে পারবেন কিছু পছন্দসই?’ আমি তখনও ধ্বন্দে;
রঙ আর ডিজাইনে আমার পছন্দ যে একটু ব্যতিক্রমী; –
বান্ধবীও শিল্পীমনা, সাদামাটায় মন উঠবে না জানি।
‘শুধু পাঁচটা শাড়ী দেখাবো আপনাকে’, ‘মোটে পাঁচটা? আর নেই বুঝি?’ –
আমি আঁতকে উঠি;
‘আছে আলমারি ভরা, কিন্তু সেসব আপনার জন্যে নয়, দেখুনই না আগে’,
মুচকি হেসে বুঝিবা চ্যালেঞ্জ জানায় দিলাবার।
পাঁচখানাই দেখিয়েছিল সেদিন; আমরা পলক ফেরাতে পারিনি।
ভয়ে ভয়ে দাম জানতে চেয়ে হোঁচট খেলাম –
এতো অবিশ্বাস্য রকমের কম! গোলমাল আছে কিছু শাড়ীতে?
বিভ্রান্তি নিয়ে ছেলেটার চোখের দিকে তাকিয়ে মিলল সব প্রশ্নের উত্তর;
‘আপনি আমার বইন, আপনার জন্যে আলাদা দাম’, কথাটা বিশ্বাস করেছিলাম সেদিন।
 এরপর থেকে দিলাবারের কাছেই যাই শাড়ীর খোঁজে,
পাঠাই বন্ধুদেরও –
দাম নিয়ে অভিযোগ করেনি কেউই, শাড়ীর মান নিয়েও নয়।

গরমের  ছুটিতে বেড়ানোর লম্বা পরিকল্পনায় অনেকদিন বাড়িছাড়া,
ইতিমধ্যে এলো সেই দুর্যোগময় রাত,শোকে স্তব্ধ ঢাকা –
আটকে পড়লাম কোলকাতায় আরও বেশ কিছুদিন।
প্রায় দুমাস পর ক্লান্ত শরীর, বিষণ্ণ মন নিয়ে ফিরলাম বাড়ী,
একটু গুছিয়ে নিয়ে মনে পড়ল, দিলাবারকে একটা শাড়ীর অর্ডার দেওয়া ছিল,
ফিরেছি জানান দেওয়া চাই, বেচারার টাকা আটকে থাকে নচেৎ।
‘আপা আপনারে ফোনে পাই না, আমার মনটা যে কেমন করে!’ ছেলেটার আকুলতা দুলিয়ে দেয় আমায়;
‘কোলকাতায় ছিলাম, তাই এখানের নম্বরটা বন্ধ ছিল’ আমি বোঝাই।
‘আপনার বাসার এত কাছে ঘটল ঘটনাটা, ফোনে পাই না –
আমি দুইরাত ঘুমাই নাই, মানত করছিলাম মসজিদে;
দুই দিন পর কাগজে নিহতদের নাম পাইয়া, তবে শান্তি; আমার বুইনের কিছু হয় নাই; -
ততক্ষণে আমি ভাষাহারা, লবণাক্ত জলে ভিজে ঠোঁট।
কখন অজান্তে আমার অস্তিত্বকে ভয়ানক দামী করে দিলো ছেলেটা,
আঁকাবাঁকা পথের বাঁকে কুড়িয়ে পেলাম এক অমৃত মাণিক;
জীবনে আর কিছু চাওয়ার বাকী থাকে কি এরপরও?  

***
©1916 ananyapal ALL RIGHTS RESERVED


মঙ্গলবার, ১৯ জুলাই, ২০১৬

কিনারা

জলের উথাল পাথাল ঢেউ, দাঁড়ের ছুপ ছুপ টানে,
ভেসে চলে নৌকোখানি কিনারার পানে;
পূবের হাওয়ায় দোল দিয়ে যায় আমার ধুসর চুলে,
আনমনে গান গেয়ে উঠি কখন মনের ভুলে;
সোনা রোদের নরম ওমে আমার গালে রঙ,
চোখ বুজে তার নরম আদর মাখি বহুক্ষণ
শ্যামলা ঘাটের কোল ছাড়িয়ে দিয়েছি পার সে কোন যুগে,
পেছন ফিরে চাইতে গেলে, চোখে তারই স্বপন জাগে,
মায়ায় বাঁধে মন

কাজলা নদীর কালো জলে, নিরুদ্দেশের অচিন নেশা,
নবীন বেলায় করেছিল আমায় যাযাবর,
সপ্ত সিন্ধু পার হব, বুক বেঁধে এই আশায়,
হলাম আমি নাবিক সওদাগর
ঘাটে ঘাটে পসরা ভরে হোল অনেক বেচাকেনা,
জমা খরচ হিসেব কষে, মিটিয়ে দিয়ে সকল দেনা,
নতুন করে ভেসেছি আজ অনেকদিনের পর

রাতের তারার শামিয়ানা, ভোরের অরুনিমা,
পাখীর ঠোঁটে বয়ে আনা টুকরো শ্যামলিমা;
ছড়িয়ে আছে চলার পথে এমন যত মণি,
দুচোখ ভরে কুড়িয়ে তাদের, আজকে আমি ধনী।
ভেসে আসা টুকরো গ্লানি, ঝড়ের রাতের আঁধার,
তাদেরও রেখেছি তুলে ভান্ডারে আমার
অপরাহ্নের শান্ত আলোয় স্পষ্ট পরপার,
সন্ধ্যা হলে সেইখানেতে বাঁধব নোঙর।
মাটির বুকে পাতব শয্যা শেষের সেই দিনে,
ঘাসের চাদর রাখবে ঢেকে পরম যতনে;
ঘাসের ফাঁকে রইবে ফুটে জমানো ধন যত,
কাঁটাও কিছু হবে শোভা ফুলের মালার মত।

©ananyapal2016

শুক্রবার, ১৮ মার্চ, ২০১৬

দায়বদ্ধ

মেয়েটি ছিল এত রোগা, যে কোমরটা একহাতে ধরা যায়,
অপটু হাতে ইস্ত্রী করা সুতির স্কুল ড্রেস ঝুলে থাকত শরীরে কাগজের ঠোঙার মত,
মাথার দুপাশে দুটো বেণী, রোগা চেহারার সাথে খাপ মিলিয়ে ডিগডিগে;
তবে শীর্ণ চেহারায় মুখখানি কিন্তু ভারি ঢলঢলে, চোখ দুটি  আশ্চর্য রকম শান্ত।
ক্লাসের ফাঁকে হিসেবহীন গল্প, বা টিফিন বেলার হুল্লোড়ে আড্ডা, কোনোটাতেই থাকত না  গীতা,
ভালো রেজাল্টের সমাদর, বা দুষ্টমির বকুনি, দুটো থেকেই ছিল সে উহ্য;
শুধু বার্ষিক খেলার রেসে দেখতাম দৌড়োয় মেয়েটা, আর অবাক করা নির্লিপ্ততায় সমাপ্তির দড়ি ছোঁয় সবার শেষে;
‘এই পালকের মত চেহারা নিয়েও হারে!’ আশ্চর্য হতাম মনে মনে, ঈর্ষাও হোত ওর নির্লিপ্ততা দেখে,
হারের তালিকায় ওর ঠিক পরের নামটিই যে থাকত আমার।

পরীক্ষার শেষে গরমের ছুটি আগতপ্রায়, ক্লাসে উপস্থিতি নগন্য,
সঙ্গীহীনতার অবকাশে সেদিন বসেছি গীতার পাশের জায়গাটিতে,
শান্ত মেয়ের নীরব হাসিতে প্রশ্রয়, গল্পের ঝুড়ি খুলে বসতে আমার কাছে সেটুকুই ছিল যথেষ্ট;
অবিরাম কলস্রোতে, মাঝে মাঝে মাথা নেড়ে অংশ নেয় আমার মিতভাষী সহপাঠিনী।
‘তোর বাবা কি করেন রে?’ অনেক কথার ভীড়ে জানতে চাই একসময়,
‘বাবা নেই, কাকা দেখাশোনা করেন আমাদের’ –
কৈশোরের রোদমাখা জীবন, স্বপ্নের বুদ্বুদে বাস, তাই এই পিতৃহীনতা অবাস্তব লাগে,
সহানুভুতি নয়, বিস্ময় জেগেছিল সেদিন, ‘বাবা নেই এমনো হয়!’
কথার মোড় ঘুরতে সময় লাগেনি বেশী, প্রসঙ্গ পালটেছিল গীতাই, ওর সাবলীল নির্লিপ্ততায়।

হাফ ইয়ার্লির রিপোর্ট কার্ড বিলি হচ্ছে ক্লাসে –
‘মনে করে স্কুল ফী দিয়ে দিয়ো তোমরা’,  কয়েক জনেরটা সরিয়ে রেখে জানালেন ক্লাস টিচার;
অভিজাত বেসরকারি স্কুল, ফী দিতে ভোলা চলে না সেখানে।
পরেরদিন বিলি হোল জমা রাখা সব রেজাল্ট, শুধু গীতারটা ছাড়া,
‘আজও ফী আনতে ভুলে গেছ?’ দিদিমণি উটকো ঝামেলায় কিছুটা বিরক্ত;
গীতা স্বভাবসিদ্ধ ভাবেই মৌন।
এভাবে চলল আরও দুটো দিন, মেয়েটার গেঁতোমিতে উত্যক্ত শিক্ষিকা,
মনে মনে চটে উঠি আমিও ওর অবাক করা ভুলোমিতে,
ভোলার অভ্যেসে মাঝে মাঝেই বকুনি যোটে আমার, তাবলে এতোখানি!

‘এ কি দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যবহার তোমার! বাড়ীর লোকই বা কি, রেজাল্ট দেখার ইচ্ছে নেই?’ –
গর্জে ওঠেন ক্লাস টিচার ছুটি পড়ার দিনটিতে অসহায় ক্রোধে;
সারা ক্লাসে থমথমে নিস্তব্ধতা, সকলের দৃষ্টি আটকে আছে পিছনে বসা রোগা মেয়েটার দিকে;
ওর আনত চোখ আর ঘেমে ওঠা মুখ দেখে হঠাৎ মনে হয়, তেমন নির্লিপ্ত লাগছেনা তো ওকে আজ!
কি যে হয়ে যায় কয়েক পলকে, অচেনা মোচড়ে খালি হয়ে যায় বুক;
ভীষণ লজ্জায় অদ্ভুত এক দায়বদ্ধতা অনুভব করি আমি -
বন্ধুর গেঁতোমিতে নয়, এ দায়বদ্ধতা আমার প্রাপ্তবয়স্ক সমাজের অনুভূতিহীনতায়।

***


©1916 ananyapal ALL RIGHTS RESERVED

শুক্রবার, ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

বেগম বাহার

আসমানী রঙে মিষ্টি পাখিটা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে দিচ্ছে তার ডানা,
ডানার ফাঁকে ফাঁকে রুপোলী জোছনা – যেন অভিমানী প্রিয়া;
ঠক্ ঠক্ ঠক্ ঠক্ ছন্দময় আওয়াজ নেশা ধরায় ঝিমোনো দুপুরে,
নিপুণ হাতের সোনারকাঠি ছুঁয়ে যায় ঘুমন্ত আকাশ,
জেগে ওঠে স্বপ্নরাজ্য মায়াজালের সুক্ষ কারুকাজে।
শিল্পীর পেলব আঙুল আত্মমগ্ন টানা পোড়েনের জটিলতায়,
একজোড়া কচিহাত তাঁতের অন্য প্রান্তে পাড় দেয় সুতোয়,
আসমানী রঙে নয়, মন পড়ে আছে তার রঙিন ঘুড়ির পিছে, উন্মুক্ত আকাশে।   

মায়াবী রাতের মধু-জোছনায় ভেসে যাচ্ছে ঘরটা,
ফুলসাজ আর আসমানী বেগমবাহারে নববধূ বেহেস্তের হুরী,
কলকা পাড়ের আঁচল  ঘিরে আছে তার লজ্জানত সুকুমার মুখ,
ভুল হয় বুঝি বা নীলসায়রের মাঝে একখানি শ্বেতপদ্ম -
পাঁপড়ি মেলবে ভোরের শিশিরের ছোঁয়ায়।
সুখস্মৃতি মেখে শাড়ীর ভাঁজে ভাঁজে শুরু হয় নতুন পথচলা,
আলতো আদরে জায়গা পায় জামদানী আলমারির মহার্ঘ কোণায়।

তাঁতঘরের কোণ ঘেঁসে চিলতে দাওয়াটাতে জ্বলছে মাটির উনুন,
ফুটন্ত ভাতের গন্ধে চনমনে বাতাস।
আগুনের তাতে শীর্ণ মুখখানি বিন্দু বিন্দু ঘামে তৈলাক্ত,
কপালে লেপ্টে থাকা চুলে শ্রাবণের ঘনঘটা;
ছেঁড়া শাড়ীর ঘোমটার ফাঁকে মুখখানি আজও মায়া জাগায়।
সুপটু আঙুলের জাদু ছড়িয়ে পড়ে বাহারে জামদানীর অলিতে গলিতে,
একখানা জামরঙা ছাপা, বৌটার জন্যে, – শাড়িটা সারতে হবে তাড়াতাড়ি;
ঠক্ ঠক্ ঠক্ ঠক্ দ্রুত হয় তাঁতের শব্দ, না কি এ শিল্পীর বুকের স্পন্দন!


©1916 ananyapal ALL RIGHTS RESERVED

বৃহস্পতিবার, ২১ জানুয়ারী, ২০১৬

মনে পড়ে?

অচিরাবতীর তীরে, ছোট একখানি গ্রাম,
একপাশে তার ছায়ামাখা তরুবীথি মঞ্জরিত বসন্ত সমাগমে;
কিংশুক রাঙা বনপথে, আমার নিত্য আসা যাওয়া গাগরী ভরনে।
দিনান্তের গোধূলী বেলায়, ধীবর নৌকাখানি ফেরে ঘাটে,
সোনামাখা জলে ছায়া ফেলে তোমার সুঠাম দেহ, হাতে মোহনিয়া বাঁশী,
বাজাও উজানের সুর বাঁশরীর তানে, মুখে স্মিত হাসি।
ক্ষণিকের চকিত চাহনি খুঁজে নেয় একে অপরের পথ চাওয়া,
আকাশের অস্তরাগ ঘন হয় আমার লজ্জানত মুখে,
নিবিড় আবেগ মুগ্ধতা আনে তোমার দুচোখে;
সাক্ষী থাকে মহাকাল।

চৈতী পূরণ্মাসী, মদনোৎসবে মাতোয়ারা কুঞ্জবন,
জাতি, যূথী, কিংশুক, চম্পকে পাতায় পাতায়  বর্ণময় আলাপন,
রাঙা বাস, হরিদ্রায় ছোপানো উত্তরীয়, গলায় চম্পক মালা,অভিসার সাজে –
যুগলে প্রেমিকের দল, ঘুরে ফেরে উৎসুক উচ্ছ্বাসে বন মাঝে।
আমি বসে থাকি ঘাটের কিনারে, কলসী হাতে, চোখে ভীরু চঞ্চলতা,
ধীরে ধীরে সূর্য মিলায় অস্তাচলে, নদীর মর্মরধ্বনি একাকার হয়ে যায় আমার বক্ষ স্পন্দনে,
শূন্য ঘাটে একেলা আমি নিস্ফল অপেক্ষায়, উৎসব দিনে আসবে না সে, মন জানে;
চন্দ্রকিরণে অচিরাবতীর জল তরল অভ্র, আমার দুচোখেও তার রেশ,
অর্থহীন করুণ বিষাদে উঠে আসে দীর্ঘশ্বাস আনমনে,
দখিনা বাতাস ছুঁয়ে যায় কপালের চূর্ণ কেশ আলতো চুম্বনে।
আলগোছে একখানি কুন্দমালিকা ঝরে পড়ে কন্ঠে আমার আচম্বিতে,
চমকে তাকাই পিছে, বাঁশী হাতে রয়েছ দাঁড়িয়ে, কন্দর্পের বেশে,
‘আজি সব অপেক্ষার শেষ’, নিবিড় আলিঙ্গনে জড়িয়ে আমায় বলেছিলে হেসে,
মনে পড়ে?    

যুগান্ত পরে, সেই কুন্দহার আজও আছে রাখা সঙ্গোপনে,
বৈজয়ন্ত সম পরম আদরে, হৃদয়ের এককোণে;
সেদিনের মোহনিয়া তান বাঁশীর সুরে,
আজও কি তোমার মনে পড়ে?

***

©2016 ananyapal ALL RIGHTS RESERVED

শনিবার, ২১ নভেম্বর, ২০১৫

আত্ম বিপণন

শীতের মরসুমে একতলার ফ্ল্যাটের চিলতে বাগানে,
ফুটেছে একটিমাত্র হলদে গোলাপ,
অনেক যত্নে আদরে বেড়ে ওঠা আমার ছাপোষা জীবনের সুখবিলাস;
হালকা ভোরের হাওয়ায় তার দুলে ওঠা,
পড়ন্ত বিকেলের মেটে আলোয় পাঁপড়ির ভাঁজে ভাঁজে জেগে থাকা স্বর্ণাভা,
ছড়িয়ে দেয় এক সুখানুভুতি আমার মনে,
গোপন গর্বে নিজেকে বিশিঢ্ট মনে হয় -
সে আমার, একান্ত আমার, ঈষৎ নুয়ে পড়া ভঙ্গীতে সম্মতি জানায় সে নিজেও।


সেদিন বিকেলে হঠাৎ ই মালিনী এলো আমার এক কামরার ফ্ল্যাটে,
আসার আগে শুধু ছোট্ট একটা মেসেজ, 'আসছি' -
মালিনী অমনই, রূপকথার পরীর মত কখনো সখনো
কয়েক লহমার সৌরভে ভাসিয়ে দিয়ে আবার হারিয়ে যায় পলকেই,
স্বপ্নময় সেই কটি মুহূর্ত জমা হয় আমার মণিকোঠায়।

শীতের আমেজভরা হিমেলী বিকেলে আমার দরজায় মালিনী,
পরণের কাঁচাহলুদ শাড়ীতে আগুনের আভা শরীরের প্রতিটি ভাঁজে,
কোঁকড়া চুলের আলগোছা খোঁপা নিপুণ অন্যমনষ্কতায়
হেলে আছে ঘাড়ের কাছে, সুন্দর মুখখানি প্রসাধনে অপরুপ;
আমি মুগ্ধ বিস্ময়ে বাকরূদ্ধ।


'এলাম দরকারে' -
জড়িয়ে পরেছে কোন বিশ্রী পুলিস কেসে, অসংযমী জীবনযাত্রায়,
আমার সাংবাদিক জীবনের যোজসাজশ কাজে লাগাতে হবে,
এটাই দরকার।
তার অভিমাণী স্বর আর মোহিনী ভঙ্গিমায়,
স্বার্থপর সাহায্যের অভিলাষ অলৌকিক মনে হয় আমার কাছে,
নিঃশর্তে নিজেকে বিকিয়ে দিতে আমি তৎপর।

কথা শেষ হয়, চলে যেতে যেতে দরজার কাছে আবার ঘুরে দাঁড়ায় মালিনী,
'গোলাপটি তো বেশ? ঠিক আমার শাড়ীর রং না?'
মিষ্টি হেসে এগিয়ে যায় সে আমার চিলতে বাগানে,
আমি অভিভূত, বাগান করা স্বার্থক মনে হয় এতদিনে।
'দেবে না আমার খোঁপায় পরিয়ে?' মালিনীর ভ্রূভঙ্গিতে আমি আত্মহারা,
ছুটে গিয়ে বৃন্তচ্যুত করি আমার দিবারাত্রের সঙ্গিনীকে,
মালিনীর খোঁপায় অভিমানে মুখ লোকায় কাঞ্চনবরণী।
গর্বিত পদক্ষেপে চলে যায় স্বপ্নের মেয়ে,
আমি বসে থাকি একা আধো অন্ধকারে আমার বাগানে;
ফুলহীন কাঁটা ঝাড় সাক্ষী হয়ে থাকে আমার বিশ্বাসঘাতকতার।
***


মঙ্গলবার, ১০ নভেম্বর, ২০১৫

কালরাত্রি

রোগাটে ছোটখাট চেহারা, গায়ের রঙটা রোদে-জলে তামাটে,
ভীতু ভীতু মুখখানি থেকে অনাহার কেড়ে নিতে পারেনি লাবন্য এখনো;
বছর দুয়েকের শিশুটিকে নিয়ে ব্যস্ত রাস্তার ফুটপাতে তার আস্তানা।
দিনভর ছেলে কোলে ভিক্ষে, কখনও বা কাঙালি ভোজন,
একটা পুঁটুলিতে গোছানো সংসার; ছেঁড়া কাঁথা, জলের গেলাস, গোটা দুই শাড়ী।
রাতের বিশ্রাম ওই ফুটপাতেই,
যেখানে সারি সারি ক্লান্ত শরীরের ভীড়ে একটা জায়গা আছে তারও;
ঝিমধরা  সাঁঝবাতির কোণ ঘেঁষে ছেঁড়া কাঁথার ছোট্ট বিছানায়।
মেয়েটা একা, তবে নিঃসঙ্গ নয়; নামহীন পুরুষসঙ্গী জোটে মাঝে সাঝে,
পেট বড় দায়;
ফুটপাতের ঘুমন্ত রাজ্য মহাস্থবির – সমাজ বহির্ভূত আরেক সমাজ,
প্রবৃত্তির নিবৃত্তি সেখানে অপরাধ নয়।

কালীপূজোর রাত, আলোকমালায় ঝলমলে শহর, তারাবাজির আলপনায় আকাশ দীপান্বিতা;
আলো আঁধারির ফুটপাতে শুয়ে আছে একদল ছায়া, বিশ্রামই তাদের একমাত্র বিলাস।
শুয়ে আছে মেয়েটাও, শরীর তার বিবশ আজ ক্লান্তিতে;
জাঁকজমকের বারোয়ারি পূজোর বস্ত্রদানের আয়োজন,
দুপুরে পৌঁছেছিল সেখানে ছেলে কোলে, একখানা কম্বলের  আশায়।
গিয়ে দেখে অসংখ্য মানুষের ঢল, 
বাঁধ ভাঙা কাঙালির ভিড়ে মরীয়া মেয়েটা প্রাণপণে ছুটেছিল দানের মঞ্চে,
ঠেলাঠেলি, প্রতিদ্বন্দ্বী ভিখারীর অশ্রাব্য চিৎকার, ছেলেটার ভয়ার্ত ক্রন্দন,
ছুঁতে পারেনি কোনও কিছুই, আসন্ন শীতে কম্বলের ওম বড় মোহময়।  
জনতার উন্মত্ত ভীড়ে বেসামাল আয়োজন, বন্ধ হয় দানসভা,
কয়েকঘন্টার পাশবিক লড়াই, প্রাপ্তির মধ্যে পুলিশের লাঠির কয়েক ঘা,
কোনক্রমে ফেরে আস্তনায়, উৎসবদিনের অভুক্ত কাঙালিনী।

ছেলেটা কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পরেছে কিছু আগে,
ক্লান্তির নিদ্রা ভিড় করে আসে তারও চোখে;
‘আসবি একবার ওদিকে?’ নেশা জড়ানো স্বরের মৃদু আহবানে সচকিত হয় মেয়েটা।
গলির মোড়ে বহুতল বাড়ির রাতের দ্বাররক্ষী,
স্বজনহীন শহরে মাঝে সাঝের সঙ্গী, উৎসব রাতে তার মনেও রোমাঞ্চ;
‘আজ ছেড়ে দাও বাবু, শরীলটা ভালো নেই’।
‘চল না পয়সা পাবি তো’, প্রথমে অর্থের লোভ, তারপর মিনতি,
নারীসঙ্গের লোভে বাবুটিও আজ মরীয়া, ভিখিরি মেয়েটার অসম্মতি অসহ্য তার কাছে
‘কি রে কানে যাচ্ছে না কথা, কিসের গুমোর এতো?’ চাপা আক্রোশে গজরায় লোকটা,
‘বলেছি তো আজ নয়; ছেলেটাকে ঘুম পাড়িয়েছি বহুকষ্টে, যাও তুমি’,
‘ছেলে? আজ আছড়ে মারব তোর ছেলে!’ ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মত তেড়ে আসে প্রবৃত্তির দাস।
নিমেষে বদলে যায় প্রেক্ষাপট,
‘ছুঁয়ে দেখো খোকাকে আমার!’ থান ইট হাতে রুখে ওঠে শান্ত মেয়েটা,
উন্মত্ত চোখের দৃষ্টি, শাড়ির আঁচল আলুথালু, রুখু খোলাচুলে সে আজ ভীষণা;
পিছুহটে বলিষ্ঠ দানব, ঔদ্ধত্ত নয় চোখেমুখে শুধুই আতঙ্ক।
উৎসবরাত্রি পূর্ণ হয় অবশেষে,
অমানিশার ঘোর অন্ধকারে, জেগে ওঠেন দানবদলনী দেবী মহা কালরাত্রি।


***