মেয়েটি ছিল এত রোগা, যে কোমরটা একহাতে ধরা যায়,
অপটু হাতে ইস্ত্রী করা সুতির স্কুল ড্রেস ঝুলে থাকত শরীরে
কাগজের ঠোঙার মত,
মাথার দুপাশে দুটো বেণী, রোগা চেহারার সাথে খাপ মিলিয়ে
ডিগডিগে;
তবে শীর্ণ চেহারায় মুখখানি কিন্তু ভারি ঢলঢলে, চোখ দুটি আশ্চর্য রকম শান্ত।
ক্লাসের ফাঁকে হিসেবহীন গল্প, বা টিফিন বেলার হুল্লোড়ে
আড্ডা, কোনোটাতেই থাকত না গীতা,
ভালো রেজাল্টের সমাদর, বা দুষ্টমির বকুনি, দুটো থেকেই ছিল সে উহ্য;
শুধু বার্ষিক খেলার রেসে দেখতাম দৌড়োয় মেয়েটা, আর অবাক করা
নির্লিপ্ততায় সমাপ্তির দড়ি ছোঁয় সবার
শেষে;
‘এই পালকের মত চেহারা নিয়েও হারে!’ আশ্চর্য হতাম মনে মনে, ঈর্ষাও হোত ওর নির্লিপ্ততা দেখে,
হারের তালিকায় ওর ঠিক পরের
নামটিই যে থাকত আমার।
পরীক্ষার শেষে গরমের ছুটি আগতপ্রায়, ক্লাসে উপস্থিতি নগন্য,
সঙ্গীহীনতার অবকাশে সেদিন বসেছি গীতার পাশের জায়গাটিতে,
শান্ত মেয়ের নীরব হাসিতে প্রশ্রয়, গল্পের ঝুড়ি খুলে বসতে
আমার কাছে সেটুকুই ছিল যথেষ্ট;
অবিরাম কলস্রোতে, মাঝে মাঝে মাথা নেড়ে অংশ নেয় আমার মিতভাষী
সহপাঠিনী।
‘তোর বাবা কি করেন রে?’ অনেক কথার ভীড়ে জানতে চাই একসময়,
‘বাবা নেই, কাকা দেখাশোনা করেন আমাদের’ –
কৈশোরের রোদমাখা জীবন, স্বপ্নের বুদ্বুদে বাস, তাই এই
পিতৃহীনতা অবাস্তব লাগে,
সহানুভুতি নয়, বিস্ময় জেগেছিল সেদিন, ‘বাবা নেই এমনো হয়!’
কথার মোড় ঘুরতে সময় লাগেনি বেশী, প্রসঙ্গ পালটেছিল গীতাই, ওর
সাবলীল নির্লিপ্ততায়।
হাফ ইয়ার্লির রিপোর্ট কার্ড বিলি হচ্ছে ক্লাসে –
‘মনে করে স্কুল ফী দিয়ে দিয়ো তোমরা’, কয়েক জনেরটা সরিয়ে রেখে জানালেন ক্লাস টিচার;
অভিজাত বেসরকারি স্কুল, ফী দিতে ভোলা চলে না সেখানে।
পরেরদিন বিলি হোল জমা রাখা সব রেজাল্ট, শুধু গীতারটা ছাড়া,
‘আজও ফী আনতে ভুলে গেছ?’ দিদিমণি উটকো ঝামেলায় কিছুটা
বিরক্ত;
গীতা স্বভাবসিদ্ধ ভাবেই মৌন।
এভাবে চলল আরও দুটো দিন, মেয়েটার গেঁতোমিতে উত্যক্ত
শিক্ষিকা,
মনে মনে চটে উঠি আমিও ওর অবাক করা ভুলোমিতে,
ভোলার অভ্যেসে মাঝে মাঝেই বকুনি যোটে আমার, তাবলে এতোখানি!
‘এ কি দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যবহার তোমার! বাড়ীর লোকই বা কি,
রেজাল্ট দেখার ইচ্ছে নেই?’ –
গর্জে ওঠেন ক্লাস টিচার ছুটি পড়ার দিনটিতে অসহায় ক্রোধে;
সারা ক্লাসে থমথমে নিস্তব্ধতা, সকলের দৃষ্টি আটকে আছে পিছনে
বসা রোগা মেয়েটার দিকে;
ওর আনত চোখ আর ঘেমে ওঠা মুখ দেখে হঠাৎ মনে হয়, তেমন
নির্লিপ্ত লাগছেনা তো ওকে আজ!
কি যে হয়ে যায় কয়েক পলকে, অচেনা মোচড়ে খালি হয়ে যায় বুক;
ভীষণ লজ্জায় অদ্ভুত এক দায়বদ্ধতা অনুভব করি আমি -
বন্ধুর গেঁতোমিতে নয়, এ দায়বদ্ধতা আমার প্রাপ্তবয়স্ক সমাজের অনুভূতিহীনতায়।
***
©1916 ananyapal ALL RIGHTS
RESERVED