কদিন আগে পতিদেব ও আমি জনা চারেক বন্ধু সমেত গেছিলাম কেনিয়ার
জঙ্গলে; আমার জঙ্গলযাত্রা
এই প্রথম, তাও একেবারে
রোমহর্ষক মাসাইমারা, এযেন একলাফে
গাছে ওঠা। চারজনের মধ্যে দুজন বন্ধু ফোটোগ্রাফার; পতিদেবও ইদানিং ওইদলে নাম লিখিয়েছেন, অতএব সাফারি সফরের রোমাঞ্চ যে কি, সে বিষয়ে সম্বৃদ্ধ হতে হতে পৌঁছে গেলাম
নাইরোবি। এয়ারপোর্টে হাজির গাইড কাম ড্রাইভার
কাকা (না
আমার খুড়ো নয়), সাফারি জীপ সাথে নিয়ে; শুনলাম এই বাহনই সামনের সাতদিন হবে আমাদের পীঠস্থান। ও হরি, মাথাখোলা হাড়গিলে এই জীপে সারাদিন চেপে
থাকলে পীঠের স্থানে কি অবশিষ্ট থাকবে ভেবে আমি ততক্ষণে হতভম্ব।
যাইহোক, ভোর না হতেই প্রতিদিন বালিশ কাঁধে ফোটোগ্রাফারের দল (ওঁদের দাবি ওগুলো বিন ব্যাগ) জীপের পশ্চাদপট দখল করেন; বাকি দুই আনাড়ী সাথী নিরাপদ দূরত্বে
সামনের দিকের সিটে, মুশকিল হোল
আমাকে নিয়ে। অবস্থার গতিকে আমাকে বসতে হয় ফোটোগ্রাফার
দলের আওতার মধ্যে, পুরস্কার
স্বরূপ কোনও জন্তু বা পাখী দেখলেই ‘স্টপ স্টপ’ বলে তারস্বরে
চ্যাঁচানোর দায়িত্ব বর্তাল আমার ওপর। চ্যাঁচ্যাঁতে
আমি চিরকালই ওস্তাদ, কিন্তু গোল
বাধল অন্য জায়গায়। ফোটোগ্রাফারের দল গদাধারী ভীমের মত
গদা, থুরী ক্যামেরা উঁচিয়ে সারাক্ষণ আস্ফালন
করেন, একটা কিছু
দেখা গেলো কি গেলোনা, তাঁদের রণহুঙ্কারে
আমি তটস্থ! একদিন ঝোপের ধারে দেখা মিলল সিংহমামার, একটা নয় গোটা তিনেক (জঙ্গল তো নয় মামারবাড়ী!); ফোটোগ্রাফার বাহিনী যথারীতি উত্তেজিত, নিজের মোবাইলে জানলা দিয়ে একটা ছবি
তোলার চেষ্টা করতেই পতিদেবের গদারূপী ক্যামেরার বাড়িতে আমার ডান হাত অবশ। ‘এত নড়াচড়া করলে এই হয়’ স্বান্তনা বাক্য নয়, খ্যাঁকানি কানে এলো। কিছুদূরে একটা সিংহছানা দেখে উত্তেজিত
হয়ে দাঁড়াতে গেছি, ‘এ তো আচ্ছা বেকুব! লায়ন কাবের
বদলে তোমার টুপীর ছবি নিয়ে বাড়ী যাব না কি?’ এক বন্ধু হুড়ো দিতে কাঁচুমাচু মুখে
বসে পড়ি। রাস্তার দুধারে দিগন্ত বিস্তৃত সাভানা
ঘাসের ঢেউ, মাঝে মাঝে
আকাসিয়া গাছ নয়নাভিরাম; এরই মধ্যে একটা গাছের মাথায় ঈগল দেখে যথারীতি ‘স্টপ’ বলে চেঁচিয়েছি। গাড়ী থেমেছে কি থামেনি, বান্ধবীর ক্যামেরা তেড়ে এলো আমার মুখের
ওপর। ‘ওরে মারা পড়ব যে!’, ‘সাফারিতে এসব একটু সহ্য করতে হয়’, আমার আর্তনাদের উত্তর মিলল। একেই লগনচাঁদা মুখশ্রী, তায় গদাপ্রহারে তুবড়ে গেলে যে বেবুনরাও
দলে নেবেনা, বোঝাই কাকে! এদিকে আর এক গেরো সামনে বসা দাদাকে
নিয়ে, ভারি গোবেচারা
দাদাটি ভালো কিছু দেখা
গেছে কানে
গেলেই উদ্ভ্রান্তের মত তাঁর দু-ফুটিয়া আইপ্যাডটি
মেলে ধরেন; এভাবে তিনি ছবি কতদূর তুলতে পেলেন জানিনা, তবে গাড়ীর সামনের কাঁচ দিয়ে খালি চোখে কিছু দেখার আশাও আমায়
ছাড়তে হোল। একবার চিতা দেখা গেলো গাড়ীর সামনে, সবাই খুব উত্তেজিত; আমি অবশ্য আইপ্যাডের কালো ঢাকনার ওপর
দুটো হলুদ কান দেখেই সন্তুষ্ট রইলাম। সুখের কথা
এই যে, দাদা আমার, সাফারিতে বেশীরভাগ সময় ঢুলেই কাটিয়েছিলেন।
দুর্গম জঙ্গুলে রাস্তায় জীপের দোদুল দোলা, সাথে দুর্ধর্ষ ফোটোগ্রাফারদের
জঙ্গী হামলা, এসব সয়ে জীবনের প্রথম সাফারি সফরের যে অভিজ্ঞতা আমার হোল, চাঁদের পাহাড়ে শঙ্করের অভিযানের
থেকে তা কম কি সে! শুধু আমার অ-ফোটোগ্রাফার বন্ধুদের জন্যে
একটা উপদেশ, ‘কুঁজোর চিৎ হয়ে শোয়ার চেষ্টা না করাই ভালো’; তারপরও নেহাৎ জঙ্গলে যেতে হলে সাথে বর্ম ও হেলমেট
নিতে ভুলবেন না; আর হ্যাঁ বালিশও একটা নেবেন, না ছবি তুলতে নয়, পিঠে গুঁজতে কাজে দেবে।
©2017 ananyapal ALL RIGHTS RESERVED