বুধবার, ১ এপ্রিল, ২০১৫

অকাল বর্ষা

আজ সারা আকাশ জুড়ে মেঘের ঘনঘটা,
ঝোড়ো হাওয়ায় গাছের পাতায় জাগায় নতুন ছন্দ,
ঝিলের বুকে ঘনায় মেঘের ছায়া, বাতাসের চুম্বনে ওঠে জলতরঙ্গ।

চৈত্রের প্রায় বিকেলের এই  নতুন রূপ মনে পরিয়ে দেয় সেই কবেকার আর এক বিকেল,
হঠাত্ִ আসা কালবৈশাখীতে সেদিন আকাশ ছিলো গম্ভীর,
হাওয়ায় ওড়া এলোমেলো চুল সামলিয়ে তোমার হাত ধরে হেঁটেছিলাম,

কিছু পরেই নামলো বৃষ্টি - তীব্র, উন্মাদ,
ভিজতে সে কি দ্বিধা তোমার, খুলতে চেয়েছিলে ব্যাগে রাখা ছাতা;
আমার উন্মাদনা সামিল করেছিল তোমায় বৃষ্টি স্নানের উত্ִসবে।

অঝোর জলধারায় খালি রাজপথে শুধু আমরা দুজন,
হাতে হাত রেখে চলেছি হেঁটে বেহিসেবী পায়ে;
অসময় ধারা কাঁপন ধরায় সিক্ত শরীরে,
মন ও কেঁপেছিলো কি তার ই সাথে?
অনেকটা পথ পেরিয়েছিলাম নিয়ে শব্দ মুখর নীরবতা।

দুই যুগ পরে আজ ও হাতে হাত,
হাঁটায় এসেছে হিসেবী ছন্দ,
অকাল বর্ষায় আমারো নেই ভেজার সাহস আর।
তোমার ব্যাগে রাখা ছাতা আড়াল করে আমায় আজ সযোতনে;
তবু সেদিনের কথা মনে পড়ে এই হঠাত্ִ বর্ষার দিনে ।

অনন্যা পাল
পয়্লা এপ্রিল
২০১৫

সোমবার, ৩০ মার্চ, ২০১৫

মন্দ মেয়ে

মারকাটারি রঙের শিফন আঁচল দুলিয়ে সে হেঁটে যায়,
সরু কোমরের হালকা দুলুনিতে জাগিয়ে মাদকতা।
‘সাজের ঘটা দেখে গা জ্বলে যায়’,
‘শাড়ী পরারই বা কি ছিরি, ঢাকছে না খুলছে বোঝা দায়!’ –
পাড়াতুতো মাসীমাদের মজলিশের এহোল নিত্য আলোচনার বিষয়।
‘অত রাত বিরেতে ফেরে, মেয়েটা করে কি?’ –
জ্যেঠুদের সান্ধ্য আড্ডাতেও এ  নিয়ে নেই জল্পনার শেষ।
‘বাপটারই বা কি আক্কেল, শাসন নেই মোটেও?
আর কচি বাচ্চা দুটো, তাকিয়ে দেখে ওদের দিকে? ভারি মা হয়েছেন!’ -
ঘোষগিন্নির পানে রাঙা ঠোঁটের কোনে স্পষ্ট বিরক্তি।
‘এসব মেয়ের কতা আর বোলোনেকো বৌদি, সাধে কি বর নিরুদ্দেশ?’ –
তাল দেয় কাজের মাসি, মন্দমেয়ের সমালোচনায় ঘুচে যায় শ্রেণিভেদ।
গলির মোড়ের চায়ের দোকানে শিবু, পটা, লিন্টনের চোখে নিল্লজ্জ কাম,
‘মালটা হেভি’ হিসহিসে মন্তব্যে ছোটে হাসির ফোয়ারা।

‘সমীর বাবু, একতলাটা তো এবার ছাড়তে হয় -
মেয়ে জামাই আসছে কোলকাতায়, ঘরগুলো চাই’।
বাড়িওয়ালার কথায় ফ্যালফ্যালে চাহনি নড়বড়ে বৃদ্ধের,
বাজারের থলে ধরা হাত আশঙ্কায় থরোথরো।
‘কোথায় যাবো রায় মশাই? আমি অসুস্থ, দুটো দুধের শিশু,
সবই তো মেয়েটার ঘাড়ে’ বৃদ্ধের গলায় মিনমিনে কাকুতি।
‘আপনার ওই মেয়ে থাকতে আর চিন্তা কি মশাই? যত ঝামেলা তো আমাদের মত ছাপোষাদের’ কথাটা হাওয়ায় উড়িয়ে ওপরে উঠে যান রায় মশাই;
কটু ইঙ্গিত বুঝিবা ছুঁতে পারেনা বৃদ্ধকে।

রাত তেমন গভীর নয়, তবে পাড়াটা ঘুমিয়ে পরেছে;
বড় রাস্তার মোড়ে গাড়ী থেকে নেমে যায় মিতালী রোজকার মতই,
বাকি পথটা হেঁটেই পার হবে।
গলির মোড়ের আধো অন্ধকারে একটা ছায়া ঘন হয়,
‘ফোন করলে ধরোনা, এস-এম-এস এর জবাব নেই;
আমাকে পুড়িয়েই বুঝি তোমার সুখ?’ –
মোলায়েম সুশিক্ষিত কন্ঠস্বরে ফুটে ওঠে আর্জি।
‘সামনের উইকেন্ডে যাবে মন্দারমনি, মিতা?’
ল্যাম্প পোস্টের আলোয় স্পষ্ট হয় সুবেশ চেহারা।
‘বাইপাসের প্রজেক্টটায় একটা ফ্ল্যাট ভেবে রেখেছি তোমার জন্যে’।
আকস্মিক চড়টা আঘাত ছাড়িয়ে বিস্ময় জাগায়;
‘ফের যোগাযোগের চেষ্টা করলে দোলা সব জানবে’ –
তীক্ষ্ণস্বরে বিপজ্জনক শীতলতা।
‘দোলা আমার বন্ধু, কথাটা ভুললে বিপদ আপনারই’।
বিদ্যুৎ বেগে এগিয়ে যায় মন্দ মেয়ে, তার প্রতি পদক্ষেপে আজ বাঘিনীর দৃপ্ততা।।


***

রবিবার, ২৯ মার্চ, ২০১৫

আমার অনুপমা

সরু চোখের দৃষ্টিতে নেই কোনো কাঙ্খিত কটাক্ষ,
না আছে খসখসে গালে সূর্যাস্তের লালিমা;
পুরু ঠোঁটের কোনায় নেই বিজয়িনী হাসি -
মুখের গড়ন নেহাৎই গড়্পড়্তা।


বছর চল্লিশের ঈষৎ ভারী শরীরে ধীর পায়ে হেঁটে যায় সে,
শোবার ঘরের জানলা দিয়ে আমি তাই দেখি প্রতিদিন;
সন্ধ্যে নামার মুখে তার এই ক্লান্ত পথ চলা,
বিন্দু বিন্দু ঘামে সাদা সিঁথির চারপাশে তারার উঁকি ঝুঁকি;
ঘাড়ের কাছে ভেঙে পরা এলোখোঁপা,
কাঁধের ব্যাগে একরাশ বইখাতা;
আট্পৌড়ে শাড়িতেও নেই কোনো বৈচিত্র।
তবু কি অসীম মোহে আমাকে সে টানে !


তাকে দেখছি আজ প্রায় দু যুগ -
মফস্বল স্কুলের দিদিমনি, পাশের পাড়ায় বাস,
যৌবনের শুরুতে চাকরিটি ছিল স্বপ্নের সিঁড়ি -
আজ বিধবা বোন, অসুস্থ বাবা আর বেকার ভাইএর সংসারের একমাত্র হারানিধি।


গোধূলির আলোয় তার পথচলা আমাকে জানলা বন্দী করে প্রতিদিন,
আবছা চিনচিনে ব্যাথায় ভরে ওঠে বুক -
গভীর রাতের অন্ধকারে মনে পড়ে ওই ঘামে ভেজা মুখ,
শ্রীহীনা, ছাঁদহীনা, সে আমার  অনুপমা।
***

বৃহস্পতিবার, ৫ মার্চ, ২০১৫

নব বসন্তে


কৃষ্নচুড়া গাছ্টার নীচে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে ছেলেটা,
কতই বা বয়স বড়জোর ষোল;
শ্যামলা রঙ, উষ্কখুষ্কো চুল নেমে এসেছে ঘাড়ে,
মুখ্টা কেমন যেন মায়া জাগায়।
পরনে হলুদ জিন্স আর নীল টিশার্ট,
একেবারে হালফ্যাশনের।


নিঝুম বসন্ত দুপুর, শব্দ বলতে শুধু কোকিলের কুহুতান,
এরই মাঝে বাঁধভাঙা ঝরনার মত এগিয়ে আসে একদল কিশোরী মেয়ে,
তাদের মিলিত কলতানে জলতরঙ্গ, হাসিতে বসন্ত বাহার।

ঠিক মাঝখানে লাজুক ছন্দে হেঁটে চলেছে যে মেয়েটি,
টিকোলো নাকের ওপর অল্প অল্প স্বেদবিন্দু, কপালে ঝুরো চুল, মুখখানি যেন সদ্য ফোটা গোলাপ।
তার আসমানি ওড়না হালকা বাতাসে দোলে, ঢেউ তোলে আর কারো মনে।

চলে যেতে যেতে সে আড়চোখে ফিরে চায়,
আটকে যায় দৃষ্টি একজোড়া মুগ্ধচোখের চাহনিতে।
এই কয়েক মুহূর্ত্তের পাওয়া ছেলেটিকে রোজ টেনে আনে গাছ্টার নীচে।


আজ হোলি, ফাগের রঙে কৃষ্নচূড়া মাখামাখি,
ছেলেটি আজও দাঁড়িয়ে ঠিক তেমনি ভাবেই,
আজ দেখা নেই মেয়ে দলের, হয়ত মেতেছে হোরিখেলায় ঘরের প্রাঙ্গনে।
ছেলেটি চেয়ে আছে উত্সুক অপেক্ষায়, সময় থেমে গেছে তার এই নীরব পথচাওয়ায়।

ভীরু পায়ে সামনের ফ্ল্যাটবাড়ির গেট পেরিয়ে মেয়েটি সামনে এসে দাঁড়ায়,
বাসন্তী শাড়ী, খোঁপায় পলাশ, হাতে আবিরের থালি।
ছেলেটি মিষ্টি হেসে রাঙিয়ে দেয় তার গাল লাল ফাগে।

অনেক না বলা কথা বলা হয়ে যায় এক পলকে,
সময় থমকে যায় চিরতরে,
রাঙা মেয়ের লজ্জা রাঙা চাহনিতে।


এ কাহিনি চিরযুগের, চিরকালের,
ওরা ছিল যমুনার তীরে, ওরা আছে নতুনের ভীড়ে, রয়ে যাবে আগামীর সুরে।
নতুন বসন্ত আসবে বারবার, সাথে আনবে বার্তা বিশ্বাসের, ভালবাসার।

***


বৃহস্পতিবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

বেনে বউ




ছোটো খাটো মিষ্টি চেহারা, কাঁচা হলুদ বরনী, ডানায় কাজল কারুকাজ;
পোষাকী নাম ব্ল্যাক হুডেড ওরিওলে -
তবে ডাক নামেই তাকে মানায় বেশী, 'বেনে বউ'।

গাছের ডালে ডালে তার ঘোরাফেরা, যেন কল্কা পেড়ে হলুদ শাড়ীতে বেনে বাড়ির লক্ষীমন্ত বউ,
মিষ্টি কুহুতানে বাজে কিশোরী নববধূর নুপুরের নিক্কন।
স্বামী তার গেছে দূর দেশে বানিজ্যে,
একেলা কিশোরী ঘুরে ফেরে এ ডালে, ও ডালে অলস দুপুরে।

বেশ কিছুদিন হোলো দেখিনি তাকে দখিনের বারান্দায় ঝুঁকে থাকা গাছ্টাতে,
হয়তো কাজ শেষে ফিরেছে স্বামী তার,
সংসারে এসেছে নতুন কচিমুখ;
ভরা সংসারের রাজপাটে আজ ব্যাস্ত গৃহিনী সে, নেই সময় আর।

আমি বসে থাকি বারান্দায় উদাসী দুপুরে,
খুঁজি সেই একেলা কিশোরীকে -
যার লজ্জা ঘন চলার ছন্দ আজো ছুঁয়ে আছে আমায়।
***

বৃহস্পতিবার, ৮ জানুয়ারী, ২০১৫

সহচরী

ধারালো ঠোঁট, আর সেই ঠোঁটে কথার ধার আরও বেশি,
সুন্দরী সে নয়, রঙ বেশ কালোই, মুখশ্রীতেও ছাঁদের অভাব;
পূবের বারান্দায় তার সাথে আমার প্রথম আলাপ,
আলাপের শুরুটাও ছেঁড়া তারের ঝঙ্কার, বেসুরো, বেতালা ।

তারপর সময়ের সাথে ঝঙ্কারে জেগেছে কোমল গান্ধার,
নরম রোদে তার মায়াময় চোখ ছুঁয়েছে আমাকে,
আমার সকাল কখন যেন আটকে গেছে ওই বারান্দায় ।

আজ আমি আছি কতদূরে –
এখানেও পূবের বারান্দায় মিঠে রোদের আনাগোনা,
ঘিরে থাকা কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে হরেক পাখীর কলতান;
তবু সেই বারান্দা, সেই একটুকরো রোদ আর সেই মৃদু আলাপন,
আনমনা করে অলস মুহূর্তে,
মনে পরে তাকে, যে আমার নামহীনা বায়স সহচরী ।

(আমার মুম্বাইয়ের বাড়ির বারান্দায় একটি কাক এসে বসতো, আমি সে বাড়িতে থাকতে যাবার আগে বারান্দাটি ছিল তারই সাম্রাজ্য। ফলে স্বভাবতঃই প্রথমদিকে আমার প্রতি তার প্রবল বিরাগ ও ক্রমশ সেখান থেকেএক অদ্ভুত বন্ধুত্বের সূচনা হয়। এই কবিতাটি আমার সেই নামহীনা সহচরীর উদ্দেশ্যে লেখা)।

***

বুধবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৪

বাহারে সমুদ্র বিহার

মেয়ের বিদেশী স্কুলে ক্রিস্টমাসের লম্বা ছুটি, বিদেশী বন্ধুরাও সব স্বদেশমুখী; অতএব ঢাকায় তার মন চঞ্চল। বললাম ‘আমরাও তো কোলকাতা যাবো, ছুটি বেশ কাটবে’, মেয়ে তার ওঁচানো নাক আরও উঁচিয়ে বলল ‘সেটা আবার বেড়ানো হোল? বন্ধুরা সব গেছে কোরিয়া, আফ্রিকা, আমেরিকা - আর আমি আধ ঘণ্টার রাস্তা কোলকাতা?’ কি বিপদ, তা বাঙালি হয়ে যখন জন্মেছ, হোম ভিসিট তো গুয়াটেমালা কিম্বা হনলুলুতে হবে না; তা সে কথা কে বোঝে! শেষমেশ বাবারূপী স্যান্টা উদ্ধারে নামলেন, ব্যাবস্থা হোল স্টার ক্রুসে সমুদ্রবিহারের সিঙ্গাপুর থেকে।

যাবার দিন, মাত্র ছঘন্টা লেট বিমান-বাংলাদেশে ‘চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে’ আবহ সঙ্গীত এবং বিকেল সাড়ে চারটেয় মাংস-ভাত ও পায়েসের মেনু দেখে যুগপৎ পুলকিত ও শিহরিত হলাম (অবশ্য ফেরার সময় সন্ধ্যে ছটাতেও মৌলিকত্ব বজায় রেখে বিরিয়ানি দেওয়া হয়েছিল এবং লোকে ভারি তৃপ্তি সহকারে তা খেয়েছিল)।
পরদিন সকালে হারবারফ্রন্ট জাহাজঘাটায় পৌঁছে মনে হোল যেকোনো আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট টার্মিনালকে লজ্জা দেবে। আমরা একটু আগেভাগেই পৌঁছেছিলাম, যাতে হুড়োহুড়ি না করতে হয়; পৌঁছে দেখলাম জনসমুদ্রের ঢল, কারন প্রায় ষাট শতাংশ যাত্রীই আমার মত ব্যাস্তবাগিশ ভারতীয়। যাত্রীরা ভারতীয় হলেও, কর্মকর্তারা কর্মঠ সিঙ্গাপুরি, তাই নিয়মের বেড়াজাল ডিঙিয়ে জাহাজে চড়তে বিশেষ বেগ পেতে হোল না । এতদিন ওসান লাইনার বইয়ে পড়েছি, আর টাইটানিক সিনেমাতে দেখেছি, এক আধবার সমুদ্র বক্ষে দূর থেকেও দেখেছি; এবার ভেতরে গিয়ে সত্যি চমক লাগার পালা, এতই সুন্দর আর বিলাসবহূল ব্যাবস্থা। প্রাইভেট ডেক অর্থাৎ ব্যালকনি সহ আমাদের কেবিনটা যেন সাজানো একটা পুতুল ঘর, আর তার সাথের স্নানঘর আরও মজার, ছোট্ট একটু জায়গার মধ্যে সবরকম সুবিধে কেমন কায়দা করে আঁটান হয়েছে না দেখলে বিশ্বাস করা শক্ত।

অর্ণব পোত
এতো নয় খেলাঘর

বারোতলা জাহাজের বিভিন্ন তলায় চেয়ার পাতা মনরম ডেক, অসংখ্য সুইমিং পুল, রেস্তরাঁ, ক্যাসিনো এবং চমকপ্রদ সব বিনোদনের বন্দোবস্ত। যাইহোক, জাহাজ পরিদর্শন শেষে ভরপেট চৈনিক আহার সেরে এগার তলার ডেক এ চেয়ারে লম্বা হলাম; ফুরফুরে হাওয়া, সামনে আ-দিগন্ত সমুদ্র, আর একটু দূরে ছোটো পুলে কয়েকটা চীনে বাচ্চার হুটোপুটি - দেখতে দেখতে কখন চোখ লেগে এসেছে বুঝতেই পারিনি। হঠাৎ একটা বাঁশফাটা চিৎকারে কলজে লাফিয়ে উঠল, আর তার সাথেই শুনতে পেলাম ঢাকের গুরু গর্জন। ব্যাপারটা ভালো করে ঠাহর করতে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি, তখনি চোখে পরল পুলের সামনে একটা ছোটো খাটো জটলা; আর সেই জটলার মধ্যমণি এক চীনে মহিলা এবং তাঁর এক দেশোয়ালি ষণ্ডা জোয়ান। নিঃসন্দেহে, শব্দ তরঙ্গের যুগলবন্দী এঁদেরই অবদান; তবে ব্যাপারটা বেশীক্ষন শুধু শব্দযুদ্ধেই থেমে রইলো না, অচিরেই পুরুষটি গলাবাজিতে পিছু হটে ঘুসি পাকাতে শুরু করল, লক্ষ অবশ্যই চিনে বিরাঙ্গনা। মহিলা তাতে দমবার নন, তাঁর কর্ণভেদী তারানা আমাদের সাথে সাথে প্রতিপক্ষ পুরুষটিকেও পর্যুদস্ত করে দিচ্ছিল। বুঝলাম জেন্ডার ইকুয়ালিটিতে চীনেরা আমাদের থেকে ঢের এগিয়ে। এবারে কৌতূহল দমন করতে না পেরে একটু খোঁজ করে মালুম হোল এঁরা পুলের খেলুড়ে দুটো বাচ্চার যথাক্রমে মা ও বাবা। বাচ্চা দুটি খেলতে গিয়ে নিজেদের মধ্যে কিছু নিয়ে ঝগড়া শুরু করে এবং মৌখিক ঝগড়ায় সুবিধে করতে না পেরে মহিলার ছেলে তার ফ্লোটারটা অন্যজনের মাথায় ভাঙে, তারই ফলে এই কুরুক্ষেত্র । যাহোক, খানিক বাদে জাহাজকর্মীদের হস্তক্ষেপে মিটমাট হোল, মহিলা অপরপক্ষের শাসানি উপেক্ষা করে ভাঙা ফ্লোটার হাতে দুর্ধর্ষ ছেলেকে নিয়ে ডেক দাপিয়ে চলে গেলেন, পিছু পিছু যাওয়া নিরীহ জীবটিকে দেখে বুঝলাম মহিলার স্বামী যাকে এতক্ষন চোখে পরেনি। বাঙালি স্বামীদেরই শুধু স্ত্রৈণ অপবাদ দেওয়া নিতান্ত অন্যায় সন্দেহ রইলো না।  

ডেক থেকে তোলা

জলকেলি

জাহাজের ডেক
রেস্তোরাঁ
ভারতীয় যাত্রিরা প্রধানত দুধরনের, একাংশ অবশ্যই মধুচন্দ্রিমা যাপনে ক্রুজে, তাদের মধ্যে উত্তর পশ্চিম ভারতের আধিক্য; আর একটা বড় অংশ গুজরাতি, যারা বাবা-মা, ছেলে-বউ, নাতিনাতনি সহ পরিবারকেন্দ্রিক ভ্রমনে এসেছেন। এক্ষেত্রে যে জিনিসটা সবচেয়ে লক্ষ করার মত, তা হোল বয়স, চেহারা ও আয়তন নির্বিশেষে খাটো পশ্চিমি পোশাকের চূড়ান্ত সমারোহ। এব্যাপারে, তন্বী নববধূ এবং মেদবতী আন্টি সব একাকার এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একের সাথে অন্যের পোশাকের ভীষণ মিল, যা দেখে অনেকবার একথাও মনে হচ্ছিলো যে পোশাকগুলো সম্ভবতঃ একই দোকানের। তা ডেক এ বসে মহিলাদের খাটো পোশাকের র‍্যাম্প ওয়াক দেখতে মন্দ লাগছিল না, যদিও তার মাঝে দু একটা ছোটোখাটো দুর্ঘটনা ঘটেছে। সে প্রসঙ্গে যাবার আগে একটা কথা বলে রাখি, ভারতীয় যাত্রীরা ডেক এ বসে সময় নষ্ট না করে সকাল থেকে রাত সুইমিং পুল, জাকুসি এবং ফ্রী রেস্তোরাঁতেই ভীড় করতেন। এবার আসা যাক দুর্ঘটনার কথায়। মাঝ সমুদ্রে প্রাক-সন্ধ্যায়, বারোতলার ডেক এ দুরন্ত হাওয়া, আমি যথারীতি ডেক চেয়ারে আধশোয়া; একটু দূরে রেলিং ঘেঁসে দাঁড়িয়ে নানান ভঙ্গিমায় ছবি তুলছে এক নবদম্পতি। আমার মত, কিছু দূরে খোলা রেস্তরাঁয় বসা এক মধ্যবয়সী দম্পতিও ওদের লক্ষ করছিলেন; কিছু পরে দেখি ভাবিজি উঠে গিয়ে দাড়ালেন রেলিং ধরে, ক্যামেরা তাক হতেই এক অভাবনীয় মুহূর্ত – ভাবীর ফ্রক উড়ে একেবারে মরিলিন মুনরো, তফাতটা শুধু আয়তনে। জাহাজের প্রতিটি ডেক এর চার কোনায় একটা করে জাকুসি সকাল থেকে রাত চালু থাকতো এবং যথারীতি এর প্রত্যেকটিই বেশিরভাগ সময় থাকতো ভারতীয়দের কবলে। দুপুর নাগাদ সেরকম একটি জাকুসি থেকে এক প্রায় বৃদ্ধা দশাসই আন্টি বেরিয়ে এলেন, উদ্দেশ্য ডেক এর অন্য প্রান্তে চেঞ্জিং রুমে যাওয়া। সুইমিং কস্টিউমে অনভ্যস্ত আন্টি দুটি তোয়ালে দিয়ে সর্বাঙ্গ ঢেকে চলেছেন ব্যাস্ত পায়ে, মাঝ বরাবর পৌঁছে হঠাৎ নিম্নাঙ্গের তোয়ালেটি গেলো খুলে; এর পরের দৃশ্য বর্ণনা করার দুঃসাহস আমার নেই।    

এবার আসি জাহাজের বিভিন্ন বিনোদন মূলক অনুষ্ঠানের কথায় (আমার অবশ্য ডেক এ বসেও বিনোদনের অভাব হয় নি)। আন্তর্জাতিক জাহাজের বিনোদনও সম্পূর্ণ আন্তর্জাতিক ও পক্ষপাত বর্জিত, সেখানে কোরিয়ান কমেডি, ব্রাজিলিয়ান নাচ থেকে বলিউড নাইট কিছুই বাদ যায় নি। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল জাহাজের ক্রু মেম্বারদের একটি অনুষ্ঠান, সেখানে হিন্দি গান, ব্যালে নাচ, হিপ হপ এমনকি জাগলারি শো দেখে এরা যে পেশাদার নয় ভাবতে অসুবিধা হচ্ছিলো। চারটি চিনে মেয়ে ভারি সুন্দর একটি চিনে গান গাইতে গাইতে স্টেজে এলো, সুরটা কেমন চেনা চেনা; আমার মেয়ে খুব কোরিয়ান গান শোনে তাই ওকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম ওটা অতিপরিচিত হিন্দি গান ‘ছাঁইয়া ছাঁইয়া’, চিনে উচ্চারণের গুণে যা অমন আন্তর্জাতিক মাত্রা পেয়েছে। অনুষ্ঠানের শেষ আইটেম ছিল তিন ‘ডিভা’ র ইঙ্গিতপূর্ন ফ্যাশন ওয়াক, আমাদের আইটেম গার্লরা যার কাছে নেহাতই জোলো। পরদিন সকালে ব্রেকফাস্টে রেস্তোরাঁর একটি ওয়েট্রসের কাছে অনুষ্ঠানের প্রশংসা করায় সে একটি ওয়েটার ছেলেকে এনে হাজির করল, ‘তুমি কিসে ছিলে?’ জিজ্ঞাসা করায় ছেলেটি লাজুক হেসে জানালো সে ওই তিন সুন্দরীর একজন। বলাই বাহুল্য এরপর আমি বাকশক্তি রোহিত।  

বলিউডেও আছি
চীনে 'ছাঁইয়া ছাঁইয়া'

সফর শেষে জাহাজ থেকে নামার সময় মনে হোল একটা মনকেমন করা অনুভুতি এই বিশাল ক্রুজের কোন ও এক কোনায় ফেলে এলাম, আর তার বদলে সঙ্গে নিয়ে এলাম একরাশ বিস্ময়, ভাললাগা আর কিছু অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা।


***