শনিবার, ১৬ মে, ২০১৫

স্মৃতি জাগানিয়া


বোশেখের অসহ্য গরমে তেলতেলে একটা দুপুর, বিরক্তিতে ঠাসা;
নির্বেদ আলস্যে হাল্কা ঝিমুনি, রাগ হয় নিজের ওপরই।

পাখাটা বড্ড আওয়াজ করে, মাছের ঝোলটা ছিলো আলুনি, বিছানাটা গরম -
রাগের নেই কারণের শেষ।

টুপটাপ-টুপটাপ, চটকা ভেঙে কান খাড়া করি,
পাখার হাওয়ায় শীতলতার আশ্বাস, ছেলেমানুষী উচ্ছ্বাসে দৌড়ে যাই বারান্দায়।
দেখি বাতাসে আঁচল উড়িয়ে খেলছে কৃষ্নচূড়া,
কচি আমের বোলে জেগেছে ঢেউ।
দেখতে দেখতে বাড়ে বৃষ্টির তেজ, ছিটে আসা জলের ফোঁটা ছুঁয়ে যায় আমার গাল,
ঠিক যেমন করে তুমি ছুঁয়েছিলে একদিন।
ঝিলের এপাড়-ওপাড় ঝাপসা, কোন যাদুতে স্নিগ্ধ চারিদিক।
ভারি নরম, গোধূলি বেলার এই সবুজের সমাহার;
ভারি মিঠে এই প্রথম বর্ষণের সোঁদা মাটির গন্ধ।
পাতার ডগায় লেগে থাকা জলবিন্দুতে,
বারান্দার কোণে ঠাঁই নেওয়া একজোড়া বুলবুলির নীরবতায়,
কিংবা জানলার কাঁচে জলের চিত্রলেখায়-
মনে পড়ে শুধু তোমাকেই।

কে বলে কালবৈশাখীর পদক্ষেপে বাজে প্রলয় দুন্দুভি?-
আমার কাছে সে যে স্মৃতি জাগানিয়া, স্বপ্ন মেদুর।

অনন্যা পাল
বৈশাখ ১৪২২




বুধবার, ১ এপ্রিল, ২০১৫

অকাল বর্ষা

আজ সারা আকাশ জুড়ে মেঘের ঘনঘটা,
ঝোড়ো হাওয়ায় গাছের পাতায় জাগায় নতুন ছন্দ,
ঝিলের বুকে ঘনায় মেঘের ছায়া, বাতাসের চুম্বনে ওঠে জলতরঙ্গ।

চৈত্রের প্রায় বিকেলের এই  নতুন রূপ মনে পরিয়ে দেয় সেই কবেকার আর এক বিকেল,
হঠাত্ִ আসা কালবৈশাখীতে সেদিন আকাশ ছিলো গম্ভীর,
হাওয়ায় ওড়া এলোমেলো চুল সামলিয়ে তোমার হাত ধরে হেঁটেছিলাম,

কিছু পরেই নামলো বৃষ্টি - তীব্র, উন্মাদ,
ভিজতে সে কি দ্বিধা তোমার, খুলতে চেয়েছিলে ব্যাগে রাখা ছাতা;
আমার উন্মাদনা সামিল করেছিল তোমায় বৃষ্টি স্নানের উত্ִসবে।

অঝোর জলধারায় খালি রাজপথে শুধু আমরা দুজন,
হাতে হাত রেখে চলেছি হেঁটে বেহিসেবী পায়ে;
অসময় ধারা কাঁপন ধরায় সিক্ত শরীরে,
মন ও কেঁপেছিলো কি তার ই সাথে?
অনেকটা পথ পেরিয়েছিলাম নিয়ে শব্দ মুখর নীরবতা।

দুই যুগ পরে আজ ও হাতে হাত,
হাঁটায় এসেছে হিসেবী ছন্দ,
অকাল বর্ষায় আমারো নেই ভেজার সাহস আর।
তোমার ব্যাগে রাখা ছাতা আড়াল করে আমায় আজ সযোতনে;
তবু সেদিনের কথা মনে পড়ে এই হঠাত্ִ বর্ষার দিনে ।

অনন্যা পাল
পয়্লা এপ্রিল
২০১৫

সোমবার, ৩০ মার্চ, ২০১৫

মন্দ মেয়ে

মারকাটারি রঙের শিফন আঁচল দুলিয়ে সে হেঁটে যায়,
সরু কোমরের হালকা দুলুনিতে জাগিয়ে মাদকতা।
‘সাজের ঘটা দেখে গা জ্বলে যায়’,
‘শাড়ী পরারই বা কি ছিরি, ঢাকছে না খুলছে বোঝা দায়!’ –
পাড়াতুতো মাসীমাদের মজলিশের এহোল নিত্য আলোচনার বিষয়।
‘অত রাত বিরেতে ফেরে, মেয়েটা করে কি?’ –
জ্যেঠুদের সান্ধ্য আড্ডাতেও এ  নিয়ে নেই জল্পনার শেষ।
‘বাপটারই বা কি আক্কেল, শাসন নেই মোটেও?
আর কচি বাচ্চা দুটো, তাকিয়ে দেখে ওদের দিকে? ভারি মা হয়েছেন!’ -
ঘোষগিন্নির পানে রাঙা ঠোঁটের কোনে স্পষ্ট বিরক্তি।
‘এসব মেয়ের কতা আর বোলোনেকো বৌদি, সাধে কি বর নিরুদ্দেশ?’ –
তাল দেয় কাজের মাসি, মন্দমেয়ের সমালোচনায় ঘুচে যায় শ্রেণিভেদ।
গলির মোড়ের চায়ের দোকানে শিবু, পটা, লিন্টনের চোখে নিল্লজ্জ কাম,
‘মালটা হেভি’ হিসহিসে মন্তব্যে ছোটে হাসির ফোয়ারা।

‘সমীর বাবু, একতলাটা তো এবার ছাড়তে হয় -
মেয়ে জামাই আসছে কোলকাতায়, ঘরগুলো চাই’।
বাড়িওয়ালার কথায় ফ্যালফ্যালে চাহনি নড়বড়ে বৃদ্ধের,
বাজারের থলে ধরা হাত আশঙ্কায় থরোথরো।
‘কোথায় যাবো রায় মশাই? আমি অসুস্থ, দুটো দুধের শিশু,
সবই তো মেয়েটার ঘাড়ে’ বৃদ্ধের গলায় মিনমিনে কাকুতি।
‘আপনার ওই মেয়ে থাকতে আর চিন্তা কি মশাই? যত ঝামেলা তো আমাদের মত ছাপোষাদের’ কথাটা হাওয়ায় উড়িয়ে ওপরে উঠে যান রায় মশাই;
কটু ইঙ্গিত বুঝিবা ছুঁতে পারেনা বৃদ্ধকে।

রাত তেমন গভীর নয়, তবে পাড়াটা ঘুমিয়ে পরেছে;
বড় রাস্তার মোড়ে গাড়ী থেকে নেমে যায় মিতালী রোজকার মতই,
বাকি পথটা হেঁটেই পার হবে।
গলির মোড়ের আধো অন্ধকারে একটা ছায়া ঘন হয়,
‘ফোন করলে ধরোনা, এস-এম-এস এর জবাব নেই;
আমাকে পুড়িয়েই বুঝি তোমার সুখ?’ –
মোলায়েম সুশিক্ষিত কন্ঠস্বরে ফুটে ওঠে আর্জি।
‘সামনের উইকেন্ডে যাবে মন্দারমনি, মিতা?’
ল্যাম্প পোস্টের আলোয় স্পষ্ট হয় সুবেশ চেহারা।
‘বাইপাসের প্রজেক্টটায় একটা ফ্ল্যাট ভেবে রেখেছি তোমার জন্যে’।
আকস্মিক চড়টা আঘাত ছাড়িয়ে বিস্ময় জাগায়;
‘ফের যোগাযোগের চেষ্টা করলে দোলা সব জানবে’ –
তীক্ষ্ণস্বরে বিপজ্জনক শীতলতা।
‘দোলা আমার বন্ধু, কথাটা ভুললে বিপদ আপনারই’।
বিদ্যুৎ বেগে এগিয়ে যায় মন্দ মেয়ে, তার প্রতি পদক্ষেপে আজ বাঘিনীর দৃপ্ততা।।


***

রবিবার, ২৯ মার্চ, ২০১৫

আমার অনুপমা

সরু চোখের দৃষ্টিতে নেই কোনো কাঙ্খিত কটাক্ষ,
না আছে খসখসে গালে সূর্যাস্তের লালিমা;
পুরু ঠোঁটের কোনায় নেই বিজয়িনী হাসি -
মুখের গড়ন নেহাৎই গড়্পড়্তা।


বছর চল্লিশের ঈষৎ ভারী শরীরে ধীর পায়ে হেঁটে যায় সে,
শোবার ঘরের জানলা দিয়ে আমি তাই দেখি প্রতিদিন;
সন্ধ্যে নামার মুখে তার এই ক্লান্ত পথ চলা,
বিন্দু বিন্দু ঘামে সাদা সিঁথির চারপাশে তারার উঁকি ঝুঁকি;
ঘাড়ের কাছে ভেঙে পরা এলোখোঁপা,
কাঁধের ব্যাগে একরাশ বইখাতা;
আট্পৌড়ে শাড়িতেও নেই কোনো বৈচিত্র।
তবু কি অসীম মোহে আমাকে সে টানে !


তাকে দেখছি আজ প্রায় দু যুগ -
মফস্বল স্কুলের দিদিমনি, পাশের পাড়ায় বাস,
যৌবনের শুরুতে চাকরিটি ছিল স্বপ্নের সিঁড়ি -
আজ বিধবা বোন, অসুস্থ বাবা আর বেকার ভাইএর সংসারের একমাত্র হারানিধি।


গোধূলির আলোয় তার পথচলা আমাকে জানলা বন্দী করে প্রতিদিন,
আবছা চিনচিনে ব্যাথায় ভরে ওঠে বুক -
গভীর রাতের অন্ধকারে মনে পড়ে ওই ঘামে ভেজা মুখ,
শ্রীহীনা, ছাঁদহীনা, সে আমার  অনুপমা।
***

বৃহস্পতিবার, ৫ মার্চ, ২০১৫

নব বসন্তে


কৃষ্নচুড়া গাছ্টার নীচে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে ছেলেটা,
কতই বা বয়স বড়জোর ষোল;
শ্যামলা রঙ, উষ্কখুষ্কো চুল নেমে এসেছে ঘাড়ে,
মুখ্টা কেমন যেন মায়া জাগায়।
পরনে হলুদ জিন্স আর নীল টিশার্ট,
একেবারে হালফ্যাশনের।


নিঝুম বসন্ত দুপুর, শব্দ বলতে শুধু কোকিলের কুহুতান,
এরই মাঝে বাঁধভাঙা ঝরনার মত এগিয়ে আসে একদল কিশোরী মেয়ে,
তাদের মিলিত কলতানে জলতরঙ্গ, হাসিতে বসন্ত বাহার।

ঠিক মাঝখানে লাজুক ছন্দে হেঁটে চলেছে যে মেয়েটি,
টিকোলো নাকের ওপর অল্প অল্প স্বেদবিন্দু, কপালে ঝুরো চুল, মুখখানি যেন সদ্য ফোটা গোলাপ।
তার আসমানি ওড়না হালকা বাতাসে দোলে, ঢেউ তোলে আর কারো মনে।

চলে যেতে যেতে সে আড়চোখে ফিরে চায়,
আটকে যায় দৃষ্টি একজোড়া মুগ্ধচোখের চাহনিতে।
এই কয়েক মুহূর্ত্তের পাওয়া ছেলেটিকে রোজ টেনে আনে গাছ্টার নীচে।


আজ হোলি, ফাগের রঙে কৃষ্নচূড়া মাখামাখি,
ছেলেটি আজও দাঁড়িয়ে ঠিক তেমনি ভাবেই,
আজ দেখা নেই মেয়ে দলের, হয়ত মেতেছে হোরিখেলায় ঘরের প্রাঙ্গনে।
ছেলেটি চেয়ে আছে উত্সুক অপেক্ষায়, সময় থেমে গেছে তার এই নীরব পথচাওয়ায়।

ভীরু পায়ে সামনের ফ্ল্যাটবাড়ির গেট পেরিয়ে মেয়েটি সামনে এসে দাঁড়ায়,
বাসন্তী শাড়ী, খোঁপায় পলাশ, হাতে আবিরের থালি।
ছেলেটি মিষ্টি হেসে রাঙিয়ে দেয় তার গাল লাল ফাগে।

অনেক না বলা কথা বলা হয়ে যায় এক পলকে,
সময় থমকে যায় চিরতরে,
রাঙা মেয়ের লজ্জা রাঙা চাহনিতে।


এ কাহিনি চিরযুগের, চিরকালের,
ওরা ছিল যমুনার তীরে, ওরা আছে নতুনের ভীড়ে, রয়ে যাবে আগামীর সুরে।
নতুন বসন্ত আসবে বারবার, সাথে আনবে বার্তা বিশ্বাসের, ভালবাসার।

***


বৃহস্পতিবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

বেনে বউ




ছোটো খাটো মিষ্টি চেহারা, কাঁচা হলুদ বরনী, ডানায় কাজল কারুকাজ;
পোষাকী নাম ব্ল্যাক হুডেড ওরিওলে -
তবে ডাক নামেই তাকে মানায় বেশী, 'বেনে বউ'।

গাছের ডালে ডালে তার ঘোরাফেরা, যেন কল্কা পেড়ে হলুদ শাড়ীতে বেনে বাড়ির লক্ষীমন্ত বউ,
মিষ্টি কুহুতানে বাজে কিশোরী নববধূর নুপুরের নিক্কন।
স্বামী তার গেছে দূর দেশে বানিজ্যে,
একেলা কিশোরী ঘুরে ফেরে এ ডালে, ও ডালে অলস দুপুরে।

বেশ কিছুদিন হোলো দেখিনি তাকে দখিনের বারান্দায় ঝুঁকে থাকা গাছ্টাতে,
হয়তো কাজ শেষে ফিরেছে স্বামী তার,
সংসারে এসেছে নতুন কচিমুখ;
ভরা সংসারের রাজপাটে আজ ব্যাস্ত গৃহিনী সে, নেই সময় আর।

আমি বসে থাকি বারান্দায় উদাসী দুপুরে,
খুঁজি সেই একেলা কিশোরীকে -
যার লজ্জা ঘন চলার ছন্দ আজো ছুঁয়ে আছে আমায়।
***

বৃহস্পতিবার, ৮ জানুয়ারী, ২০১৫

সহচরী

ধারালো ঠোঁট, আর সেই ঠোঁটে কথার ধার আরও বেশি,
সুন্দরী সে নয়, রঙ বেশ কালোই, মুখশ্রীতেও ছাঁদের অভাব;
পূবের বারান্দায় তার সাথে আমার প্রথম আলাপ,
আলাপের শুরুটাও ছেঁড়া তারের ঝঙ্কার, বেসুরো, বেতালা ।

তারপর সময়ের সাথে ঝঙ্কারে জেগেছে কোমল গান্ধার,
নরম রোদে তার মায়াময় চোখ ছুঁয়েছে আমাকে,
আমার সকাল কখন যেন আটকে গেছে ওই বারান্দায় ।

আজ আমি আছি কতদূরে –
এখানেও পূবের বারান্দায় মিঠে রোদের আনাগোনা,
ঘিরে থাকা কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে হরেক পাখীর কলতান;
তবু সেই বারান্দা, সেই একটুকরো রোদ আর সেই মৃদু আলাপন,
আনমনা করে অলস মুহূর্তে,
মনে পরে তাকে, যে আমার নামহীনা বায়স সহচরী ।

(আমার মুম্বাইয়ের বাড়ির বারান্দায় একটি কাক এসে বসতো, আমি সে বাড়িতে থাকতে যাবার আগে বারান্দাটি ছিল তারই সাম্রাজ্য। ফলে স্বভাবতঃই প্রথমদিকে আমার প্রতি তার প্রবল বিরাগ ও ক্রমশ সেখান থেকেএক অদ্ভুত বন্ধুত্বের সূচনা হয়। এই কবিতাটি আমার সেই নামহীনা সহচরীর উদ্দেশ্যে লেখা)।

***