গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

সোমবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

লুটের বাতাসা

মেয়ের বিদেশী স্কুলে কমিউনিটি সার্ভিস তথা নানা সমাজসেবামূলক কাজকর্ম হয়ে থাকে, সেসব কাজের জন্য অর্থের যোগাড়ও হয়ে থাকে বিভিন্ন উপায়ে; যথা নানান অনুষ্ঠান (ডান্স পার্টি, থিয়েটার ইত্যাদি), সর্বোপরিসেলএ জামাকাপড় বিক্রি থেকে এইসেলব্যপারটা ভারি জনপ্রিয় এবং প্রতিবারই নির্ধারিত দিনে অভিভাবকেরা যেরকম মরীয়া হয়ে সমাজসেবায় ছুটে আসেন, তা সত্যিই হৃদয়স্পর্শী

আমরা তখন ঢাকায় সদ্য এসেছি, স্কুলে নতুন; খবর পেলাম এরকম একটি সেলের। মেয়ের সহপাঠিনীর মা, ভারী উপকারী, নিজে থেকেই উৎসাহ দিলেন, ‘দুশো টাকা রেটে ঢালাও প্যান্ট, জামা, ড্রেস, এমনকি গরম জামা পর্যন্ত; সব ভালো ভালো ব্রান্ডের’ আমাকে এর বেশী বলার প্রয়োজন হোলনা, সমাজসেবার মহৎ উদ্দেশ্যে ততক্ষণে আমি অদম্য যাইহোক, নির্দিষ্ট দিনে সময়ের বেশ কিছু আগেই বেরিয়ে পরলাম নিমরাজি মেয়েকে বগল দাবা করে; ওকে সঙ্গে নেবার মুল উদ্দেশ্য ভীড়ের মাঝে বোঁচকা সামলানো, মুখে অবশ্য বললাম, ‘নিজে পছন্দ করে নিতে পারবে, ভালো হবে না?’ পৌঁছে দেখি হলের বন্ধ দরজার সামনে কাতারে কাতারে জন সমাবেশ; আকৃতি, প্রকৃতি, বর্ণ, জাতির বৈচিত্রে মিল শুধু একটাই, হাতে সকলেরই বড় বড় ঝোলা। বুঝলাম, এ বড় শক্ত ঠাঁই; ‘চোখ, কান খোলা রেখো’ মেয়েকে সতর্ক করে রেসের ঘোড়ার মত তেরিয়ে রইলাম দরজা খোলার অপেক্ষায়। এভাবে কাটল বেশ খানিক্ষন, স্বাভাবিক নিয়মেই একটু আলগা হয়েছে আমার তৎপরতা; অমনি আচমকা খুলে গেলো গুপ্তধনের গুহা। কিছু বোঝার আগেই প্রায় ভাসতে ভাসতে ঢুকে পড়লাম ভেতরে, ভাগ্যিস মেয়ের হাতটা ধরা ছিল তাই নিরুদ্দেশ ঘোষণার প্রয়োজন হোল না। তবে মুশকিল অন্য দিকে, ঢুকে তো পড়লাম, কিন্তু থামা দায়। এ টেবিল, ও টেবিল পেরিয়ে স্রোতে ভাসতে ভাসতে উপায় না দেখে শেষে একখানা টেবিল ক্লথ প্রানপনে খামচে ধরলাম। যাক, এবার থামা গেছে ভেবে সুস্থির হবার আগেই, ‘এক্সকিউস মি’ তীক্ষ্ণ হুংকারে চমকে দেখি, টেবিল ক্লথ নয়, আমি এক শ্বেতাঙ্গিনীর সাদা ফ্রকের কোনা চেপে ধরে আছি। কোনমতে ক্ষমা চেয়ে তেড়ে গেলাম সামনের টেবিলে ঢাঁই করে রাখা টিশার্টের দিকে।একটা বেগুনী টপ চোখে লাগল, হাত বাড়াতেই একটা থাবা নাকের ওপর দিয়ে সেটা উড়িয়ে নিয়ে গেলো; এরপরে লাল, সবুজ, কমলা তাক করেও কোনটাই কব্জা করতে পারছি না। এবার একটা লেসের কলার ওয়ালা নীলচে টিশার্ট নজরে আসতেই প্রানপনে চেপে ধরলাম, টানবার আগেই এক ছ-ফুটিয়া লালমুখো তার আর এক দিক চেপে ধরল। সেও ছাড়বে না, আমিও হয় এসপার নয় ওসপার; খানিক চলল এই টাগ অফ ওয়ার, শেষে আমার গোঁ দেখে সাহেব রণেভঙ্গ দিলো, জয়ের উল্লাসে আত্মহারা আমি খেয়াল করলাম না টানাটানিতে সাধের কলার ভীতু কুকুরের কানের মত ছেতরে গেছে। এভাবে যুদ্ধনীতি খানিক রপ্ত হতে ঠিক করলাম বাছাবাছি পরে, আগে যা পাই ওঠাতে হবে; এ ব্যাপারে দেখলাম মেয়ে আমার থেকে চৌকশ, মিনিট দশেকের মধ্যেই খান কুড়ি জামা কাপড় বাগিয়ে ফেলল। যা হোক বাছাবাছির সুযোগ নেই, তাই মোটামুটি আন্দাজে সাইজ দেখে নিয়ে কাপড়ের বান্ডিল জড়ো করে এগোলাম কাউন্টারের দিকে। ভল্যান্টিয়ার হিসেব কষছেন, তাতেও শান্তি নেই; এক ক্ষীণতটি পীতাঙ্গীনি (সম্ভবতঃ টেবিলে টেবিলে বিশেষ সুবিধে করতে না পেরে) ফিরতি পথে আমার সংগ্রহে হাত বাড়িয়েছেন। ‘এক্সকিউস মি’ এবারে আমি হুংকার দিলাম অনেকটা ‘সিংহাম’ স্টাইলে।    

ব্যাগ বোঝাই ও পকেট হালকা করে বাড়ি ফিরে সদর্পে পসরা খুলে বসলাম; উদ্দেশ্য আমার বিচারবুদ্ধির ওপর সম্পূর্ণ আস্থাহীন বাড়ির কর্তাটিকে তাক লাগিয়ে দেওয়া। প্রথমেই দুটো টপ বেরোল, একটা মেয়ের বছর দুয়েক আগেকার সাইজ, অন্যটাতে মা মেয়ে দুজনে একসাথে ঢুকে যাওয়া যাবে। এ ভাবে কোনটার বিটকেল আকৃতি, কোনটার বা উৎকট রঙ মোটের ওপর আমার মত অতি উৎসাহীর ও কাছাখোলা অবস্থা। ‘হরির লুটের বাতাসা, মন্দ কি!’ কথাটা হাওয়ায় উড়িয়ে আমার স্বল্পভাসী পতিদেব ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন; যেতে যেতে যে খিঁকখিঁকে হাসিটা উপহার দিয়ে গেলেন, মনে হোল একশটা ডেঁয়ো পিঁপড়ে একসাথে কামড়ে দিলো।   
  

***

শুক্রবার, ১৭ অক্টোবর, ২০১৪

হাসতে নেই মানা......


হাসতে নেই মানা......                   

মে মাসের প্রথম সপ্তাহ, পচা গরমে শরীর হাঁসফাঁস । অভিজাত স্কুলের গাছপালা ঘেরা খোলামেলা বিল্ডিং তাই রক্ষে; তবে গরমের ছুটির আর মোটে দিন দুয়েক অপেক্ষা তার পর আর পায় কে! টেনের ক্লাসরুমে বসে একমনে পেন্সিল চিবুতে চিবুতে সে কথাই ভাবছিলাম । সদ্য শেষ হওয়া হাফ ইয়ারলি পরীক্ষার খাতা টাতা বেরচ্ছে তাই বেশ একটা চাপা উত্তেজনা, আমি অবশ্য ‘রাগ দুঃখ ভয় তিন থাকতে নয়’ গোছের দর্শনে বিশ্বাসী তাই আপাততঃ মা টিফিনে কি দিয়েছে সেই নিয়ে গবেশনায় ব্যাস্ত । ইতিহাসের দিদিমণি মিসেস রয় ক্লাসে ঢুকলেন, হাতে যথারীতি উত্তরপত্রের গোছা । ‘এগুলো তোমাদের নয়, তোমরা কাল পাবে’ ব্যক্তিত্বময়ী সদাপ্রসন্না দিদিমনি আজ মনে হোল তেমন প্রসন্ন নন । নিজের জায়গায় বসে গম্ভীর মুখে জানতে চাইলেন ‘X-A র মিতালী বসু কে চেন তোমরা?’ চুপচাপ নিরীহ মিতালী হঠাৎ এত বিখ্যাত কি করে হোল ভাবার চেষ্টা করছি, দিদি নিজেই ব্যাপারটা খোলসা করলেন । ‘একটু আগে মিতালীর খাতা চেক্ করছিলাম, তাই ওর সম্বন্ধে আগ্রহ বোধ করছি’ । আমি তো শুনে থ! মিতালী তো জানতাম পড়াশোনায় আমার থেকেও সরেশ, এর আগে আমরা এক সেকশানে পড়েছি; কলিকালে কত কি যে দেখব! ‘তোমাদের এখন মিতালীর খাতা থেকে সম্রাট কনিষ্কের ওপর যে প্রশ্ন ছিল তার উত্তর পড়ে শোনাচ্ছি, মন দিয়ে শুনে বলবে কি বুঝলে’ । উত্তেজনায় এবং খনিক ঈর্ষায় আমার পেটের ভেতর গুড়গুড়, যাই হোক দিদিমণি তাঁর উদ্দাত্ত গলায় শুরু করলেন ।
‘কনিষ্ক অনেক দিক থেকেই আর সব সময়কালীন রাজার থেকে আলাদা ছিলেন এবং তার প্রথম কারণ হল তিনি মুণ্ডহীন ছিলেন । মুণ্ডহীন হওয়া সত্তেও বুদ্ধিতে ও পরাক্রমে অন্য মুন্ডওয়ালা রাজাদের থেকে কোনও অংশে কম ছিলেন না । যুদ্ধক্ষেত্রে যখন শত্রু তাঁকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলত, বিনা মুণ্ডেও তিনি অর্জুনের মতই লক্ষভেদ করতে পারতেন । শুধু তাই নয় মুণ্ডহীনতা সত্তেও তিনি সঙ্গীত ও সাহিত্যের অনুরাগী ছিলেন । শুধু একটা বিষয়েই তাঁর বিশেষ অসুবিধে ছিল, মুণ্ড না থাকায় সম্রাটের মুকুট মাথায় পরার সুবিধে ছিল না, তবে মনে হয় সেটা তিনি কোমরবন্ধে ঝুলিয়ে কাজ চালিয়ে নিতেন’  -
বাকিটা শোনার মত অবস্থা তখন ক্লাসের কোনও মেয়েরই আর নেই, উদ্বেলিত হাসি চাপার অসীম চেষ্টায় সকলের মুখ লাল । আমি মনে মনে ক্ষনজন্মা মিতালী কে স্যালুট না জানিয়ে পারলাম না । শুধু দিদিমনির মুখে থমথমে গাম্ভীর্য, ‘এটা কি আমাকে অপমানের চেষ্টা?’ উনি দেখলাম ব্যাপারটা ব্যাক্তিগত পর্যায়ে নিয়ে গেছেন । নিরীহ, ল্যাকপ্যাকে মিতালীকে আর যাই হোক ঠিক অপমানকারিনী হিসেবে ভাবতে পারলাম না ।
***
প্রসঙ্গতঃ বলে রাখি, সম্রাট কনিষ্কের একটি মাত্র প্রতিকৃতি মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেছে, সেটি কালের প্রবাহে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে মুণ্ডহীন ছিল । ফলে ইতিহাসের বইয়ে তাঁর যে ছবি পাওয়া যায়, সেটি সেই মুণ্ডহীন ধরের প্রতিকৃতি । 

Publishied in Prothom Alo on 11th December, 2015

বুধবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

পিরীতি বিষম জ্বালা

প্রেমে পরাটা বাঙ্গালীদের একটা বাতিকের মত, বিভিন্ন বয়সে একেক রকম ভাবে দেখা দেয় । যেমন স্কুলে পরতে ভীতুভীতু প্রেম, আবার কলেজ জীবনে কবিতা লেখার তাগিদে মরীয়া প্রেম। তাছাড়া ধরুন, পাশের বাড়ির নতুন ভাড়াটেদের সুন্দরী মেয়েটিকে দেখে জানলার পাশে ঘাঁই দিয়ে বসে উদাসী প্রেম; অথবা বাস স্ট্যান্ডে রোজ দেখা মেয়েটির পিছু নিয়ে তার বাড়ী অবধি ধাওয়া করে দুরন্ত প্রেম এব্যাপারে আপামোর বাঙ্গালিরই কিছু না কিছু অভিজ্ঞতা থাকতে বাধ্য, তার কিছু টক, কিছু মিষ্টি আর কারো কারো কপালে হয়ত শুধুই তেঁতো । তবে একথা স্বীকার করতে বাধা নেই যে আমার প্রেম বিষয়ক অভিজ্ঞতা শুধু অপূর্ব নয় সম্ভবতঃ অভূতপূর্বও এবং যতরকম প্রেম বাঙ্গালির সহজাত তার প্রায় প্রত্যেকটিই আমার ঝুলিতে বর্তমান 
একেবারে গোড়া থেকে শুরু করলে ব্যাপারটা বেশ ফরসা হবে। তখন পড়ি ক্লাস সেভেনে, আমার প্রিয় বান্ধবী গরমের ছুটিতে মামাবাড়ি গিয়ে প্রেমে পরলেন। প্রেমে তো শুধু পরলেই হয়না তাকে জল-সার দিয়ে টিঁকিয়ে রাখাও চাই; আর সমস্যাটা বাধল সেখানেই। কারণ মামাবাড়ি কোলকাতার বাইরে, পত্রালাপ ছাড়া গতি নেই। এদিকে বাড়িতে চিঠি এলে ধরা পরার ভয়। অতএব অগতির গতি এই শর্মা, বন্ধুর প্রেমকে মসৃণ করার মহৎ কাজে তখন আমাকে ঠেকানো দায়। নিজের বাড়িতে চোরের মত পরের চিঠির আশায় ওঁত্ পেতে থাকি, আর কাঙ্খিত সুগন্ধি রঙিন খামটি এলেই চিলের মত ছোঁ মারি পিওনের কাছ থেকে। এভাবে চলছিলো বেশ (অন্তত আমার বন্ধুর হাবেভাবে তো তাই মনে হোতো), বিপদ এল অন্য দিক থেকে। এক রোববার একটা ফোন আসার পরই বাবা গম্ভীর মুখে ডেকে জানতে চাইলেন কবে থেকে পরের কালোয়াতিতে পোঁ দিচ্ছি (ভাষাটা এক না হলেও বক্তব্যটা প্রায় তাই ছিল)? ‘প্রাণ যায় পর বচন না যায়’ কায়দায় চুপ করে থেকে সেদিন দুর্গতির একশেষ, অন্ততঃ বামাল সমেত ধরা পরা বান্ধিবীর থেকে তো কম নয়ই। যাই হোক এর পর বান্ধবীর প্রেমরোগ তো সারল, কিন্তু আমার?
আমার পোঁ দেওয়ার সেই শুরু, বান্ধবীদের হয়ে অর্ডারি প্রেমের-চিঠি লেখা এবং তার জবাব এলে আরও জুতসই একটা প্রত্যুত্তর দেওয়া আমার সাহিত্যচর্চার (যা কিনা বাঙ্গালির আর একটা বাতিক) একটা গুরুতর অঙ্গ হোল; অবশ্য এব্যাপারে উৎসাহ দিয়ে গাছে ওঠাতে বন্ধুরা কোনও ত্রুটি রাখেনি। তবে আমার সাহিত্যকীর্তি অন্য মাত্রা পেল বেশ কিছুদিন পরে। এক বান্ধবী তার অর্ডারি চিঠি আমার থেকে নিয়ে গিয়ে কপি না করে সিধা পাঠিয়ে দিতে লাগলো প্রেমিক প্রবরকে (প্রেমের ব্যাস্ততায় নষ্ট করার মত সময় কোথায়?)একদিন সেও চিঠি পাঠানোর আগেই বামাল সমেত গ্রেপ্তার; এক্ষেত্রে গোয়েন্দাটি তার দিদিচিঠিতে আমার ভুবনমোহিনী হাতেরলেখা চিনতে ভুল হবার নয় আর তা হোলও না। ফলে সেবার প্রানের সাথে কান নিয়েও জবর টানাটানি।  
এবার আসি কলেজ প্রেমের কথায়। তখন সবে ফার্স্ট ইয়ার, এক শীতের সকালে আমার বেস্টফ্রেন্ড (বন্ধু, বান্ধবী নয়) হন্তদন্ত হোয়ে টেনে নিয়ে গেলো লেডিস কমন রুমের সামনে। ‘ব্যাপার কি?’ আমি খানিক ভ্যাবাচ্যাকা। ‘নন্দিনী এখুনি ঢুকেছে, আমি দেখেছি’ বন্ধুর ধোঁয়াটে জবাব। ‘তাতে আমাদের কি?’ ‘আরে অনেক কিছু। শিগগিরই গিয়ে আমার নাম করে ফোন নম্বরটা চেয়ে নে’। ‘আমি কেন নিজে নে না’ আমার সরব প্রতিবাদ। ‘আরে গাধা লেডিস রুমে আমি ঢুকলে সবাই মিলে চামড়া গুটিয়ে নেবে না?’ বন্ধুর যুক্তি অকাট্য, কদিন আগে আমিই এহেন ঘটনার সাক্ষী ছিলাম (বেচারা নতুন পড়ুয়াটি পাশের টিচার্স রুমের সাথে গুলিয়ে ফেলেছিল)। আমি এরপরেও গাঁইগুঁই করছি, প্রধানতঃ নন্দিনীর ডাকসাইটে উন্নাসিকতার কারণে। ‘ইয়ে ইশক নেহি আসান,এক আগ কা দরিয়া হ্যায়, অউর ডুবকে জানা হ্যায়’ বন্ধু গর্জে উঠল। ‘কিন্তু ইশক তো তোর, আগুনের সমুদ্রে আমি কেন?’ আমার মিনমিনে জবাবের তোয়াক্কা না করে আমাকে ও প্রায় ঠেলে চালান করে দিলো ভেতরে, শুধু তাই নয় দরজার সামনে পাহারায় রইলো যাতে পালিয়ে যেতে না পারি। নিজের বন্ধুভাগ্যে এতদিন পরেও আমি নিজেই রোমাঞ্চিত।
‘হাই! আমি সেকশান-এ’। ‘জানা আছে, নন্দিনীর কাঠখোট্টা জবাব। আমি আরেকটু ঘন হবার জন্যে দুএকটা কথা বলি যা নিজের কানেই অত্যন্ত বোকাবোকা ঠেকে। নন্দিনী আমাকে ঝেড়ে ফেলে মন দেয় নিজের সাজসজ্জার দিকে। ‘তুমি সুমন্তকে চেনতো? তোমাদের সেক্সানের’। আমি প্রসঙ্গে আসার জন্যে মরীয়া। ‘হু কেয়ারস্’! ‘না মানে ও তোমার সাথে বন্ধুত্ব করতে চায়’। ‘কিন্তু আমি চাইনা’। ‘কেন? ও কিন্তু খুব ভালো ছেলে’। সুপারিশের উত্তরে আমার পেছনের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে নন্দিনীর জবাব, ‘ভালো মানে তো ক্যাবলা, না হলে এধরনের প্রিমিটিভ ফ্রেন্ড জোটায়’। কানে আগুন, চোখে জল নিয়ে আমি কমন রুমের বাইরে

নিজের ইশক আসান কিনা জানিনা, তবে বন্ধুর ইশক যে পুরোপুরি আগুনের সমুদ্র তা আমার চেয়ে কেউ বেশি জানে না।

***

বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ, ২০১৪

মানে না মানা

‘রাগ করেছো?’ মোবাইলে মেসেজটা দেখে ভাবতে বসলাম কাকে কাকে দুএকদিনের মধ্যে দাঁত খিঁচিয়েছি । ‘জবাব দিচ্ছনা যে, এতো রাগ!’ ‘আচ্ছা আমি নাহয় মাফ চাইছি হোল তো?’ এযে মেঘ না চাইতেই জল! শেষ কবে কেউ এমন মিষ্টি করে আমার রাগ ভাঙিয়েছে মনেই পরে না (বাড়িতে বাকিদের মানভঞ্জনের মনপলি আমারই কিনা) । ভাবছি জবাবে কি লিখি, এরমধ্যেই আরেকটা মেসেজ, ‘নীপা প্লিজ কিছু বল’ । যাক এতক্ষণে সব ফরসা হোল, মেসেজ গুলো নীপা নাম্নী এক সৌভাগ্যবতীর; মানে যার রাগ অন্ততঃ একজনের কাছেও ভারি দামী । বেচারি প্রেমিকের জন্যে প্রাণটা কেমন হুহু করে উঠল, জবাবে লিখলাম, ‘আমি তো নীপা নই, আপনার বোধহয় কিছু ভুল হয়েছে’ ।  ‘ভুল তো হোয়েছেই, আর সেতো আমি স্মীকার করছি, তাবোলে আমাকে এড়াতে বলে দিলে তুমি নীপা নও!’ ‘না না বিশ্বাস করুন আমি সত্যি নীপা নই, নীপা নামের কাউকে চিনিও না’ । ‘নীপা তুমি যদি বারবার এরকম বল আমি কিন্তু ঠিক একটা কিছু করে বসবো!’ আমি আতঁকে উঠি, শেষে কি আত্মহত্যার প্ররোচনায় জেলে যাবো! মেসেজের অভিমানী হুমকি সমানে চলছে; অনেক ভেবে মেসেজ করলাম, ‘বেশ তবে আমাদের বাড়িতে এসে যা বলার বল, আমি শুনবো’ । ভাবলাম, মোবাইল নম্বর ভুল হয়েছে বলে বাড়ির নম্বর তো আর ভুল হবে না, ফলে সমস্যা মিটবে । ‘নীপা সত্যি বাড়িতে ডাকছ? কোন গোলমাল হবে না তো?’ ‘না না গোলমাল কিসের, তুমি বাড়ির সামনে এসে একটু দাঁড়াও, ঠিক একটা ব্যবস্থা হবে’ আমি স্বান্তনা দিই । ‘বেশ তবে আসছি, ঠিক দশ মিনিটে বারান্দায় এসো আমায় দেখতে পাবে’ ।

খানিক পরে আবার মেসেজের গুঁতো, ‘কি হোল, বারান্দায় এসো, দেখ তোমার পছন্দের লাল টিশার্টটা পরেছি’ । এবার আর জবাব দিলাম না ।  সবে বিকেলের চা টা নিয়ে বসেছি, বাইরে থেকে ক্রিকেট বল এসে পরল বসার ঘরে; আজকাল এই এক জ্বালাতন পাড়ার হবু শচিন দের নিয়ে । রাগ করে বলটা বাইরে ফেলতে বারান্দায় গিয়ে আমি থ; লাল টিশার্ট পরা এক রোমিও জুলুজুলু চোখে চেয়ে আছে আমাদের বিল্ডিঙের দিকে । তেল সাবান না জোটা লম্বা চুল, গালে খোঁচা দাড়ি বছর পঁচিশের এক ছোকরা; আগে কোনদিন দেখেছি বলে মনে পরে না । কি বিপদ, শেষে মেসেজগুলো কি আমাকেই করেছিল নাকি? আমার সন্দীপা নামটাকেই ছোটো করে নীপা; মাথা একেবারে ঝিম ঝিম, ভেতরে এসে সোফায় বসলাম কোনমতে । প্রেম অন্ধ একথা অনস্বীকার্য, তাবোলে দেড়া বয়সের এক খিটকেল মহিলা! ছোকরার পছন্দের মাথামুণ্ডু পেলামনা, এদিকে চা জুড়িয়ে ঠাণ্ডা । এরমধ্যে বেলটা বেজে উঠল, কি জানি ছোঁড়ার এতো সাহস শেষে ফ্ল্যাটে হানা! ভয়ে ভয়ে দরজা খুলে দেখি বীথি, হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম । বীথি আমাদের নীচের ফ্ল্যাটে থাকে, মাস কমুনিকেসনে মাস্টার্স করছে, ভারি মিষ্টি মেয়ে; বউদি বলে ডাকে, মাঝে মাঝে গল্প করতে আসে আমার সাথে । সকালে ও আমার একটা শাড়ী নিয়েছিল, কলেজের কোন অনুষ্ঠানে পরবে বলে, বুঝলাম ফেরত দিতে এসেছে, ‘এতো তাড়া কিছু ছিলনা বীথি’ আমি ভদ্রতা করি । ‘তাড়া ছিল বইকি বউদি, দাদার ফোনটা আসায় দৌড়ে এলাম ফেরত দিতে’ । মাথাটা গুলিয়ে গেলো, ওকে ভেতরে আসতে বলে বসে পরলাম । ‘দাদা ফোন করে শাড়ী ফেরত দিতে বলল’? ‘ধ্যাৎ, কিযে বল; শাড়ী নয় এটা ফেরত দিতে এসেছি’ ও নিজের মোবাইলটা এগিয়ে দিলো । ‘মানে?’ আমি হতচকিত । আরে সকালে গল্পের চোটে ভুলে তোমারটা নিয়ে গেছিলাম, এখন দাদার ফোনটা পেয়ে বুঝতে পারলাম’ । আমাদের দুজনের মোবাইলের মডেল এক, অতঃপর......... এতক্ষণে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল । ‘আমারও তোমাকে কিছু ফেরত দেবার আছে নীপবীথি’ । ‘কি?’ ‘সেটা বারান্দায় গিয়ে দেখ নীপা’ আমি হেসে বলি ।


***
Published in Prothom Alo on 21st March, 2016

বুধবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

দাদাগিরি

এমনিতেই আমার মাথাগরম বলে বদনাম, তার ওপর রীতিমত চর্চা করা তাগড়া চেহারা; লোকে আমায় বিশেষ ঘাঁটায় না । পাড়ার ভালো মন্দের দায়, ছেলে ছোকরাদের ওপর নজরদারি, সে একরকম আমি নিজের দায়িত্ব বলে মনে করি; তাতে মাঝে মধ্যে একে ওকে একটু কড়কাতে হলে কি বা এসে যায়! তবে আজ সকাল থেকেই বিলের কাণ্ড দেখে মেজাজ আমার সপ্তমে, এর একটা শেষ না দেখে আমি আর ছাড়ছি না । বেশ কিছুদিন ধরেই ঘোষ বাড়ীতে ওর চুপি চুপি যাতায়াত আমি লক্ষ করেছি, মিয়াঁ বিবি যখন কাজে যায় তখনই বেটা উঁকি ঝুঁকি মারে খিড়কির দরজা, নয় রান্নাঘরের জানলা দিয়ে । কার সায়ে এসব চলছে তাও বুঝি; গেলো মাসে ভালবেসে ও বাড়ির মিনিকে একটা ফিস ফ্রাই খাওয়াতে চেয়েছিলাম । তা দোকান থেকে বাগিয়ে আনতে একটু ঠাণ্ডা হয়ে গেছিল আরকি, অমনি মুখ ঝামটে বলল ‘বাসি খাবার আমি খাই না!’ আর এই ছিঁচকে বিলে, তার ওপর কি দরদ!

আজ তিতলিদির জন্মদিন, ঘোষ বাড়িতে হেভি খাওয়া দাওয়া, পাড়াশুদ্ধু লোকের নেমন্তন্ন; আমিও যাবো, তবে একেবারে শেষের দিকে, নেমন্তন্নের ধার আমি ধারি না । তাই তো বিলেটাকে সন্দেহ, আমি তো জানি ব্যাটা চুরি বিদ্যেয় এরই মধ্যে হাত পাকিয়েছে, নির্ঘাত লোকের ভিড়ে হাতসাফাইয়ের তালে আছে । আর চুরির দোসর যখন ঘরেই মজুত তখন আর পায় কে! কিন্তু আমি থাকতে সেটি হতে দিচ্ছিনা, তক্কে তক্কে আছি, আজ হাতে নাতে ধরে ওকে পাড়া ছাড়া করে তবে আমার শান্তি ।

বাড়ির ভেতর থেকে মাছের কালিয়া আর ভেটকির পাতুরির গন্ধে রাগটা প্রায় গলে যাবার জোগাড়, কিন্তু না, কর্তব্যে অবহেলা এ শর্মা করে না, তাই না পাড়ায় আমার এতো খাতির! যাইহোক, দিপুদের পাঁচিলের আড় থেকে আমি ঠিকই নজর রাখছি হতচ্ছাড়া বিলের ওপর । লোকজন বেশ কিছু আসতে শুরু করেছে, মিনি ঢঙ করে তিতলিদির সাথে সাথে ঘুরছে, যেন জন্মদিনটা আজ ওরই! খাওয়ার আসরে হাঁকডাক বাড়ছে, ঠাকুর সামাল দিতে নিজেই পরিবেশনে হাত লাগিয়েছে; এই মওকায় বিলে একলাফে বাড়ির ভেতর, আর যায় কোথায় আমিও মারলাম এক লাফ, একেবারে বিলের ঘাড়ে । দুজনে গড়াতে গড়াতে রান্নাঘরের দরজায়, গায়ের জোরে ব্যাটা নেহাত কম যায় না, সঙ্গে তেমনি গলার জোর, জাপটাজাপটি, গর্জন; আজ কেউ একপা পিছব না, যা থাকে কপালে । ‘আ মল যা, এদুটো আবার ঠিক জুটেছে! মাছের গন্ধ পেয়েছে কি হতচ্ছাড়াদের দৌরাত্ব শুরু । ফেলে দিয়ে আয় তো ন্যাপা দুটোর ঘেঁটি ধরে!’ ন্যাপার ঠাকুমার খোনা গলার চিৎকার কানে যেতে না যেতেই ‘ঝপাস!’ কে যেন খামচে নিয়ে চুবিয়ে দিলো ড্রেনের জলে । অপমানে চোখে জল এলো, এই দুনিয়ায় ভালো কারো করতে নেই । এতো যে নিঃস্বার্থে পাড়ার দেখাশুনো করি, নাহয় দু চারটে মাছের টুকরো তার বদলে খাজনা ভেবেই নিই, তাবোলে ছিঁচকে বিলে আর আমি এক হলাম!

এর থেকে তো মাছ খাওয়া ছেড়ে দেওয়াই ভালো.................. নাহ্ সেটা বোধহয় পারা যাবে না!



***

শুক্রবার, ৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

গরম ভাতে কাসুন্দি




অফিস টাইমের ভিড়, বাসটা মানুষের চাপে একদিকে হেলে পরেছে । দাদা একটু চাপুন তো!এক মুশকো জোয়ান হাঁকল মহিলা সিটের সামনে একপায়ে ভরে দিয়ে ঝুলে থাকা এক মিহি গোঁফকে । কি ব্যপার এবার কোলে বসবেন নাকি?’ জবরদস্ত মাসিমা ঝাঁঝিয়ে উঠলেন । দুদিকের হুড়োতে মিহি গোঁফ দিশেহারা, এরপর একেবারে ট্রাপিজের কায়দায় রড ধরে সিলিঙে ঝোলা যায় কিনা ভেবে দেখছেন । এই যে একটু সরে বসুন তো, বাচ্চাটাকে একটু বসতে দিন’; ‘কোথায় সরব আর জায়গা কোথায়?’ ‘কোনার সিটে অমন বেঁকে বসে আছেন আর জায়গা নেই! নিন সোজা হয়ে বসে বাচ্চাটাকে বসতে দিন। কথপোকথন চলছে বছর তিনেকের বাচ্চা কোলে এক অল্পবয়সী মা ও টিপটপ এক কলেজ পড়ুয়া আধুনিকার মধ্যে । আধুনিকা কথা না বাড়িয়ে সামান্য সোজা হয়, তাতে যে ইঞ্চি ছয়েক জায়গা হোল সেখানে বাচ্চা সমেত মা বসলেন বা বলা চলে বসার চেষ্টা চালালেন । ওরে বাবারে, হাঁটুটা একবারে থেঁতলে গেলো, ওইটুকু জায়গায় এতোবড় শরীর নিয়ে কেউ বসে!ফলতঃ এপাশের বউদির আর্তনাদ । এতবড় শরীর বলতে আপনি কি বোঝাচ্ছেন, আপনার শরীরই বা কম কিসে?’ ‘দেখুন, শরীরের খোঁটা দেবেন না, আমি আপনার খাই না পরি?’ ‘শুরু তো আপনিই করলেন!’ ‘একে জোর করে বসলেন তারওপর ঝগড়া করছেন লজ্জা করে না?’ ‘লজ্জা কেন করবে আপনি আমার শাশুড়ি নাকি?’ ‘ভাগ্যিস নই যা মুখ!’ চোপ, একেবারে চোপ! সকাল সকাল কোথায় একটু শান্তিতে যাব, তা না কাক চিল বসতে দেবে না!অল্পবয়সি মা আর বউদির যুগলবন্দীতে মাসিমার তারানা ।

অ্যাই, কি হচ্ছে সোজা হয়ে দাঁড়ান না, বাড়িতে মা বোন নেই নাকি?’ না কোনও দিদিমণি নয়, ঝাঁকড়া চুল কাঁধে ঝোলা বছর বাইশের এক দাদামনি সুর করে ধমকালেন মুশকোকে । যাচ্চলে, আপনি মা না বোন?’ মুশকোর ঠোঁটে নচ্ছারি হাসি । ছোটলোক!দাদামনি তাঁর অভিধানের সবচেয়ে চোখা গালিটি ঝাড়লেন, মুশকোর হাসি চওড়া হোল ।

দরজার কাছে ভিড় ঠেলে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন এক লম্বা বেনী দিদিমিনি, ‘একটু ভেতরে ঢুকতে দিন না’, দিদিমণির কাতর আহ্বান যেন রবি ঠাকুরের গান, মনে দোলা দেয় । আপাততঃ অবশ্য বাসটাই এমন দুলিয়ে দিলো যে লম্বাবেনী এক ছাপোষা দাদার একেবারে বুকে; আহা! যেন উত্তম সুচিত্রার এই পথ যদি না শেষ হয়’, অবশ্য ছাপোষা বউদি যদি দৃশ্যটা দেখতেন তাহলে পথের শেষ কোথায় গিয়ে হোত কে জানে! 

তখন থেকে বলছি সোজা হয়ে দাঁড়াতে, তবু হুঁশ নেই? আগে সোজা হয়ে দাঁড়ানো শিখে তবে বাসে উঠবেন, যতোঃসব !’  বাসের দুলুনিতে মিহি গোঁফও মাসিমার পদানত; এক্ষেত্রে অবশ্য প্রতিক্রিয়াটা প্রায় মহিষাসুর দলনী দুর্গার মত। দাদা টিকিট!ঠিক এইসময়ই কন্ডাক্টারের হাঁক মিহিগোঁফকে, ‘ব্যাপারটা কি বাস চালাতে পারেননা ঠিক করে আর টিকিট চাইতে এসেছেন?’ মাসিমার অপমানের ঝালটা পরল কন্ডাক্টারের ওপর । বাস ঠিকই চলছে, আপনার অসুবিধে হয় নেমে ট্যাক্সি করে যানসেও সমান তেরিয়া । কি বাস ঠিক করে চলছে? তখন থেকে ঢিকির ঢিকির যেন গরুর গাড়ী আবার ট্যাক্সি দেখানো?’ এবার সরব হলেন এক গম্ভীর চেহারার মেশোমশায়, আর তাঁর সাথে তাল জুড়ল প্রায় গোটা বাস । যা বলেছেন এই করেই কলকাতাটা একেবারে উচ্ছন্নে গেল । কথায় কথায় ভাড়া বাড়াবে অথচ কাজের বেলায় ফক্কা। বেগতিক দেখে কন্ডাক্টার সরে পরে, আলোচনা মোড় সম্পূর্ণ রাজনৈতিক । ‘এই যে কদিন পরপর ভার বাড়ানোর স্ট্রাইক এর পেছনে বিরোধীদের চক্রান্ত নেই ভেবেছেন?’ ‘আরে মশাই এ সবই সরকারের কারসাজি, ভোটের আগে ব্যাটাদের হাতে রাখতে চায়’। ‘মোটেই না কেন্দ্রীয় সরকার সব ব্যাপারে হাত উলটে বসে আছে তো রাজ্য সরকারের কি দোষ?’ ‘দেখুন মশাই সব কথায় কেন্দ্রকে টেনে আনবেন না, যতো বাহানাবাজ!’ ‘দেখুন মুখ সামলে, কেন্দ্রের নামে বললে আপনার গায়েই বা লাগছে কেন?’ ‘আপনি মুখ সামলে!’

ডালহৌসি, ডালহৌসি!কন্ডাক্টারের চিল চিৎকার যেন যুদ্ধবিরতির ঘোষণা; মৌচাকে ঢিল পরার মতই লেগে যায় হুড়োহুড়ি, লক্ষ্য একটাই, তাড়াতাড়ি বাস থেকে নামা । 

***

বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী, ২০১৪

কুল না ফুল?


শীতের দুপুরে মেয়েকে সাথে নিয়ে গেছি একজোড়া চটি কিনতে, তা অনেক দেখা দেখি করে একটা বেশ পছন্দ হল; কিন্তু আমার আধুনিকা কিশোরী মেয়ে ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল ‘লুক অ্যাট ইয়োর ফিট মাম্মা ইটস নট কুল!’ মেয়েকে গ্রাহ্য না করে জুতোটা কিনে বাইরে এসে মনে হোল কথাটা বোধহয় মিথ্যে নয়, ঠাণ্ডায় এবং অযত্নে আমার চরণ যুগল প্রায় কাকের ঠ্যাং এ পরিণত হয়েছে। কথাটা মাথায় ঘুরছিলো, হঠাৎ রাস্তার মোড়ে একটা ভারি চমকদার বিউটি পার্লার চোখে পরল। ভাবলাম বরং এখান থেকে খানিক পদমার্জনা করিয়ে পায়ের ভোল ফেরাই; তাতে পা দুখানা আমার প্রাণপাতের না হোক অন্ততঃ প্রনিপাতের* যোগ্য তো হবে (প্রসঙ্গতঃ গীতগোবিন্দে কেষ্ট ঠাকুর ‘দেহি পদ পল্লব মুদারম’ বলে শ্রীরাধার চরণে প্রাণটা প্রায় দিয়েই ফেলেছিলেন আর কি)! যেমন ভাবা, আমরা মা মেয়ে ঢুকলাম ভেতরে; ঢুকতেই কাউনটারের মেয়েটি কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়েই আগে নাম ঠিকানা মোবাইল নম্বর লিখে নিল। প্রথম ধাক্কা সামলে নিজের প্রয়োজনের কথা জানালাম; যাই হোক আর একটি মেয়ে বেশ যত্ন করে ভেতরে নিয়ে বসিয়ে পদসেবা শুরু করল গরম জলের ছ্যাঁকা, নরুনের খোঁচা আর খামচাখামচির মাঝখানে হঠাৎ দেখি এক অতি সুসজ্জিতা মহিলা ভারি আন্তরিক ভাবে আলাপ করতে এলেন। মহিলার চাকচিক্যে আমি তো মোহিত, জানতে পারলাম ইনিই পার্লারের দিদিমণি, মানে মালকিন আর কি। ‘তা ভাই আপনি ফেসিয়াল কোত্থেকে করান আপনার স্কিন কিন্তু খুব ভালো’ ওঁর প্রশংসা বাক্য আমাকে শাড়ীর দোকানের কর্মচারীদের কথা মনে করিয়ে দিল, পৃথিবীতে একমাত্র ওরাই আমাকে ‘ফরসা’ বলে থাকে শাড়ী গছানোর জন্যে। ‘করিনা তাই ভালো আছে’ কথাটা কেমন মুখ ফসকে বেরিয়ে গেলো, তবে মহিলা ওধার দিয়েও গেলেন না। ‘সেকি ফেসিয়াল করেন না, তবে আজই শুরু করুন’। ‘কিন্তু আপনি তো বললেন স্কিন ভালো’ আমার জবাব। ‘আহা হা, এখন ভালো আছে, কিন্তু আচমকা একদিন সকালে উঠে দেখবেন চামড়া একেবারে কুঁচকে গেছে। আর ফেসিয়াল করলে বহুদিন আপনি একই রকম সুন্দরী থাকবেন’, আবার শাড়ী দোকানের কথাটা মনে হোল যা হোক বুড়ো হতে আমার তেমন আপত্তি নেই; আর তাছাড়া আপত্তি করলেই কি আর বুড়ো হওয়া ঠেকানো যাবে? কিন্তু হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে আয়ানায় নিজের কোঁচকান মুখ দেখতে ভালো লাগবে কিনা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। তাই জিজ্ঞসা করলাম ‘তা আপনাদের কিরকম চার্জ টার্জ?’ ‘দেখুন ফেসিয়াল অনেক রকম, তবে আপনার জন্য গোল্ডটাই সবচেয়ে ভালো হবে’। ‘গোল্ড! মানে সোনা?’ আমি তো হতচকিত। ‘হ্যাঁ একেবারে ২৪ ক্যারাট’। ‘নানা সেকি, সোনার তো আজকাল এমন দাম যে নাম মুখে আনতেও ভয় লাগে। গেলো বছর মামাতো ভায়ের বিয়েতেই সোনা দিতে পারিনি আর শেষে কিনা মুখে মেখে নষ্ট করবো’! আঁতকে উঠে বলি। ‘তাহলে এক কাজ করুন আপনি বরং পার্ল ফাসিয়াল করুন, আপনাকে খুব সুট করবে’। ‘পার্ল মানে আপনি মুক্তোর কথা বলছেন? সেটাও নিশ্চয়ই আসল?’ আমার প্রশ্নে দিদিমণি মিষ্টি করে হেসে সায় দিলেন। ‘দেখুন, এক আধ ছড়া মুক্তোর হার আমার আছে বটে কিন্তু সেতো সবই হায়দ্রাবাদী। আসল মুক্ত তো কেবল মিউসিয়ামেই দেখেছি। এতটা বাড়াবাড়ি করা বোধহয় ঠিক হবে না’। ‘বেশ তবে বরং আপনি ফ্রুট ফেসিয়াল করুন, সেই বা মন্দ কি!’ মহিলাকে যত দেখছি ওঁর প্রতি শ্রদ্ধা যেন আমার বেড়ে উঠতে লাগলো। ‘তা ফ্রুট ফাসিয়ালের ব্যাপার টা কি?’ আমি বেশ কৌতহল বোধ করলাম। ছেলে ভোলানো মায়ের স্নেহে দিদিমণি বোঝাতে লাগলেন, ‘দেখুন আঙুর, পেঁপে, বেদানা, এই যে সব ভালো ভালো ফল এই দিয়েই আমাদের ফ্রুট ফেসিয়াল; স্কিনের পক্ষে ভারি ভালো’। ‘সেকি ফলের যা দাম, তা এগুলো মুখে মেখে নষ্ট না করে খেলে ভালো হয় না?’ এতক্ষণে দিদিমণির মাখন গালে একটু বিরক্তির ভাঁজ পরলো, ‘তা আপনার যা বাজেট মনে হচ্ছে তাতে আপনি হারবাল ফেসিয়াল করুন’। ‘সেটা কি রকম?’ আমি এখনো কৌতুহলি। ‘এ হোল গিয়ে শাক সবজি লতা পাতার ব্যাপারযাক তাহলে এটাই আমার পক্ষে ভালো। আজই বাড়ী গিয়ে রান্নাঘরের জিনিষ টিনিষ দিয়ে ব্যাপারটা সেরে ফেলব এখনএতক্ষণে আমি স্বস্তির নিঃশাস ফেলি। তাড়াতাড়ি পদসেবার বিল মিটিয়ে মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে এলাম। দিদিমণিও আঁধার মুখে আমাকে বেড়াল পার করে বাঁচলেন।

মেয়ের মুখ দেখে অনুমান করলাম সে একটুও খুশী নয় আমার ব্যাবহারে। বুঝলাম, ফুল (fool) হতে চাইনি বলে কুল (cool) হওয়া আমার হোলনা!

* যারা আমার মত সেকেলে বুড়ি নয় তাদের সুবিধার্থে জানাই, প্রনিপাত মানে প্রণাম করা; তা আজকাল প্রণামের রেওয়াজ যেমন উঠে গেছে এসব শব্দের প্রয়োজনও তেমন ফুরিয়েছে।

*****
Published in Prothom Alo on 4th April, 2016

বৃহস্পতিবার, ৯ জানুয়ারী, ২০১৪

একটি রূপকথা

সে অনেক কাল আগের কথা, এক ছিলেন রাজা চন্দ্রকেতু, প্রকৃতির কোলে শস্য শ্যামল তাঁর রাজ্য আনন্দপুর। রাজ্যে কোনও কিছুরই অভাব নেই, প্রজারা সুখী, খুশী রাজকর্মচারীরাও । রাজা মশাই বড় ভালো মানুষ, পরের সুখেই তাঁর আনন্দ । তবু এর মাঝেই রয়েছে একটা ছোট্ট অস্বস্তি; রাজা যুবক, দেখতে শুনতেও ভালই, কিন্তু তাঁর গায়ের রঙ বেজায় কালো । এই রঙ নিয়ে তাঁর মনে যত সংশয়;  কালো রাজা না জানি কত হাসির পাত্র । সংশয় এমন যে রাজ প্রাসাদে না আছে কোনও আয়না, না কেউ পরে কালো রঙের কাপড়; এমনকি, রাজার সামনে মন্ত্রী, আমলা কেউ ‘কালো’ কথাটাও ব্যবহার করে না পাছে রাজা দুঃখ পান । এইত সেদিন রাজদরবারে সভাকবি সুর করে ধরেছেন তাঁর নতুন কবিতা,-

আমার মন প্রাণ সব চুরি গেছে আজ,

আমি গোয়ালিনী অবলা;

শ্যাম নাম জপী সারা দিনমান,     

চুরি করে কোথায় পালালেশালা’!’


গান শুনে রাজা মশাই ভ্যাবাচ্যাকা, কবির মুখ কাঁচুমাচু; আর বাকি পারিষদের ঠোঁটে মুচকি হাসি । আসলে কবিবর লিখেছিলেন ‘কালা’ কিন্তু গাইতে গিয়ে তড়িঘড়ি ভুল শোধরাতে শেষে শ্বশুর পুত্রকে স্মরণ ।

এতো গেল রাজসভার কথা, রাজ্যের বাইরে যেতেও রাজার ভারি সঙ্কোচ । কদিন আগে প্রতিবেশী রাজ্য হুতোমপুরের রাজকন্যের স্বয়ম্বরের এলো নেমন্তন্ন; মেয়ের বাপ কতো বিনয় করে চিঠি পাঠালেন; সুশীল, ধনবান, তার ওপরে একটাও বিয়ে হয়নি এখনও, এমন জামাই পেতে কোন রাজাই না চান! কিন্তু তাতে কি, রাজা চন্দ্রকেতু অম্লশূলের বাহানায় নেমন্তন্ন ফেরত দিলেন; সুন্দরী রাজকন্নে, এতো রাজার মাঝখানে যদি কালো মুখ দেখে ঠোঁট বেঁকায়!

দিন যতো যায় মন্ত্রীরা চিন্তায় পরেন, রাজ্যে একজন রানীর প্রয়োজন নতুবা বংশলোপের সম্ভাবনা । এ অবস্থায় রাজবয়স্য অনেক মাথা চুলকে, নস্যি সেবন করে সকাল সন্ধ্যে তামুক ফুঁকে একটা বুদ্ধি বের করলেন । একদিন রাজাকে একা পেয়ে কথাটা পেড়েই ফেললেন, ‘আমি বলি কি মহারাজ, রাজকন্যেতে কাজ নেই আপনি বরং বেশ একটি সাদামাটা দেখে রানী আনুন ঘরে । পার্বতী বিনে ভোলানাথকে কি মানায়?’ ‘তোমার বক্তব্যটা কি হে ঘণ্টেশ্বর? একটু সোজা কথায় বল’ । ‘আজ্ঞে, আমাদের প্রধান্মন্ত্রীমশাই; তাঁর ধরুন গিয়ে মা ষষ্ঠীর কৃপায় গণ্ডা খানেক কন্যা, আর চেহারাপত্র তাদের বাপের মতই। হেঁ হেঁ অতএব হবু স্বামীর চেহারা নিয়ে তাদের কোনও মাথাব্যাথাই হবে না (প্রসঙ্গতঃ প্রধানমন্ত্রী দেবদূত বর্মাকে তাঁর চেহারার কারনে আড়ালে লোকে যমদূত বলে ডাকে)’ । কথাটা শুনে রাজার চোখের দৃষ্টি ঘন হয়ে এলো, ‘আমি বোধহয় এখন সকলের দয়ার পাত্র তাই না?’ ‘সেকি মহারাজ, না না!’ ঘণ্টেশ্বর লজ্জা পেয়ে পালাতে পথ পেলেন না ।

এক চৈতালি পূর্ণিমার সন্ধ্যেয় রাজা বিশ্রাম করছেন তাঁর রম্যদ্দানে; যূথী-মালতীর গন্ধে চারিদিক মাতোয়ারা, দখিনা বাতাসে শীতলতার আভাস । হঠাৎ ভারি মিষ্টি নারীকণ্ঠের গান ভেসে এলো কিছু দূর থেকে, এতো গান নয় যেন সুরের মূর্ছনা । চন্দ্রকেতু মন্ত্রমুগ্ধের মত এগিয়ে গেলেন গান লক্ষ করে । বাগানের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে একটি নালা, নালার ওপর কিছু দূরে দূরে বাঁধা আছে মনোরম কাঠের পুল, আর তার চারপাশে নানান ফুলের গাছ । এমনই একটি পুলের ধারে বকুল গাছের নীচে বসে আছে এক পরমা সুন্দরী মেয়ে; আকাশের চাঁদ হার মেনেছে তার  মুখশ্রীর লালিত্যে, সোনার বরণ মেয়ের রঙের ঔজ্জ্বল্যে জোৎস্নাও ম্লান। রাজা খানিক অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন রূপসীর দিকে, তারপর হঠাৎ সঙ্কুচিত হয়ে পরলেন নিজের কারনে । তিনি ফিরেই যাচ্ছিলেন নিঃশব্দে, কিন্তু গানের কথা তাঁকে আটকাল।

শ্রীমতী ভোলে শাসন বারণ কানুর দেখা পেলে -

ফুল ভোলে তার রূপের গুমোর ভোমরা কাছে এলে

কালো আঁখি ঢলঢল বাড়ায় মুখের শোভা

চাঁদের আলোয় কালো বরণ বড়ই মনোলোভা


গান কি তাঁকেই শুনিয়ে গাইছে ও মেয়ে? একি কোনও ছলনা না মনের ভুল? এতো সব ভাবনার মাঝেই সে মেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে সামনে, তার হাতে বকুল ফুলের মালা ।

কালো-সাদা, রাত-দিন; একে মধ্যে অন্যে লীন  

আমার আলো ফুটবে কি গো তোমার আঁধার বিন?’


মালা দিয়ে রাজাকে বরণ করে নেয় দেবদুত বর্মার একমাত্র রূপবতী গুণবতী মেয়ে কাঞ্চনমালা; ঘণ্টেশ্বরকে উশকে রাজার কাছে পাঠনোর বুদ্ধি সেই দিয়েছিল তার বাবাকে ।   
এরপর ধুমধাম করে রাজার বিয়ে হল, আমার কথাটি ফুরল – নোটে গাছটি মুড়ল ।


*****