শনিবার, ২১ নভেম্বর, ২০১৫

আত্ম বিপণন

শীতের মরসুমে একতলার ফ্ল্যাটের চিলতে বাগানে,
ফুটেছে একটিমাত্র হলদে গোলাপ,
অনেক যত্নে আদরে বেড়ে ওঠা আমার ছাপোষা জীবনের সুখবিলাস;
হালকা ভোরের হাওয়ায় তার দুলে ওঠা,
পড়ন্ত বিকেলের মেটে আলোয় পাঁপড়ির ভাঁজে ভাঁজে জেগে থাকা স্বর্ণাভা,
ছড়িয়ে দেয় এক সুখানুভুতি আমার মনে,
গোপন গর্বে নিজেকে বিশিঢ্ট মনে হয় -
সে আমার, একান্ত আমার, ঈষৎ নুয়ে পড়া ভঙ্গীতে সম্মতি জানায় সে নিজেও।


সেদিন বিকেলে হঠাৎ ই মালিনী এলো আমার এক কামরার ফ্ল্যাটে,
আসার আগে শুধু ছোট্ট একটা মেসেজ, 'আসছি' -
মালিনী অমনই, রূপকথার পরীর মত কখনো সখনো
কয়েক লহমার সৌরভে ভাসিয়ে দিয়ে আবার হারিয়ে যায় পলকেই,
স্বপ্নময় সেই কটি মুহূর্ত জমা হয় আমার মণিকোঠায়।

শীতের আমেজভরা হিমেলী বিকেলে আমার দরজায় মালিনী,
পরণের কাঁচাহলুদ শাড়ীতে আগুনের আভা শরীরের প্রতিটি ভাঁজে,
কোঁকড়া চুলের আলগোছা খোঁপা নিপুণ অন্যমনষ্কতায়
হেলে আছে ঘাড়ের কাছে, সুন্দর মুখখানি প্রসাধনে অপরুপ;
আমি মুগ্ধ বিস্ময়ে বাকরূদ্ধ।


'এলাম দরকারে' -
জড়িয়ে পরেছে কোন বিশ্রী পুলিস কেসে, অসংযমী জীবনযাত্রায়,
আমার সাংবাদিক জীবনের যোজসাজশ কাজে লাগাতে হবে,
এটাই দরকার।
তার অভিমাণী স্বর আর মোহিনী ভঙ্গিমায়,
স্বার্থপর সাহায্যের অভিলাষ অলৌকিক মনে হয় আমার কাছে,
নিঃশর্তে নিজেকে বিকিয়ে দিতে আমি তৎপর।

কথা শেষ হয়, চলে যেতে যেতে দরজার কাছে আবার ঘুরে দাঁড়ায় মালিনী,
'গোলাপটি তো বেশ? ঠিক আমার শাড়ীর রং না?'
মিষ্টি হেসে এগিয়ে যায় সে আমার চিলতে বাগানে,
আমি অভিভূত, বাগান করা স্বার্থক মনে হয় এতদিনে।
'দেবে না আমার খোঁপায় পরিয়ে?' মালিনীর ভ্রূভঙ্গিতে আমি আত্মহারা,
ছুটে গিয়ে বৃন্তচ্যুত করি আমার দিবারাত্রের সঙ্গিনীকে,
মালিনীর খোঁপায় অভিমানে মুখ লোকায় কাঞ্চনবরণী।
গর্বিত পদক্ষেপে চলে যায় স্বপ্নের মেয়ে,
আমি বসে থাকি একা আধো অন্ধকারে আমার বাগানে;
ফুলহীন কাঁটা ঝাড় সাক্ষী হয়ে থাকে আমার বিশ্বাসঘাতকতার।
***


মঙ্গলবার, ১০ নভেম্বর, ২০১৫

কালরাত্রি

রোগাটে ছোটখাট চেহারা, গায়ের রঙটা রোদে-জলে তামাটে,
ভীতু ভীতু মুখখানি থেকে অনাহার কেড়ে নিতে পারেনি লাবন্য এখনো;
বছর দুয়েকের শিশুটিকে নিয়ে ব্যস্ত রাস্তার ফুটপাতে তার আস্তানা।
দিনভর ছেলে কোলে ভিক্ষে, কখনও বা কাঙালি ভোজন,
একটা পুঁটুলিতে গোছানো সংসার; ছেঁড়া কাঁথা, জলের গেলাস, গোটা দুই শাড়ী।
রাতের বিশ্রাম ওই ফুটপাতেই,
যেখানে সারি সারি ক্লান্ত শরীরের ভীড়ে একটা জায়গা আছে তারও;
ঝিমধরা  সাঁঝবাতির কোণ ঘেঁষে ছেঁড়া কাঁথার ছোট্ট বিছানায়।
মেয়েটা একা, তবে নিঃসঙ্গ নয়; নামহীন পুরুষসঙ্গী জোটে মাঝে সাঝে,
পেট বড় দায়;
ফুটপাতের ঘুমন্ত রাজ্য মহাস্থবির – সমাজ বহির্ভূত আরেক সমাজ,
প্রবৃত্তির নিবৃত্তি সেখানে অপরাধ নয়।

কালীপূজোর রাত, আলোকমালায় ঝলমলে শহর, তারাবাজির আলপনায় আকাশ দীপান্বিতা;
আলো আঁধারির ফুটপাতে শুয়ে আছে একদল ছায়া, বিশ্রামই তাদের একমাত্র বিলাস।
শুয়ে আছে মেয়েটাও, শরীর তার বিবশ আজ ক্লান্তিতে;
জাঁকজমকের বারোয়ারি পূজোর বস্ত্রদানের আয়োজন,
দুপুরে পৌঁছেছিল সেখানে ছেলে কোলে, একখানা কম্বলের  আশায়।
গিয়ে দেখে অসংখ্য মানুষের ঢল, 
বাঁধ ভাঙা কাঙালির ভিড়ে মরীয়া মেয়েটা প্রাণপণে ছুটেছিল দানের মঞ্চে,
ঠেলাঠেলি, প্রতিদ্বন্দ্বী ভিখারীর অশ্রাব্য চিৎকার, ছেলেটার ভয়ার্ত ক্রন্দন,
ছুঁতে পারেনি কোনও কিছুই, আসন্ন শীতে কম্বলের ওম বড় মোহময়।  
জনতার উন্মত্ত ভীড়ে বেসামাল আয়োজন, বন্ধ হয় দানসভা,
কয়েকঘন্টার পাশবিক লড়াই, প্রাপ্তির মধ্যে পুলিশের লাঠির কয়েক ঘা,
কোনক্রমে ফেরে আস্তনায়, উৎসবদিনের অভুক্ত কাঙালিনী।

ছেলেটা কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পরেছে কিছু আগে,
ক্লান্তির নিদ্রা ভিড় করে আসে তারও চোখে;
‘আসবি একবার ওদিকে?’ নেশা জড়ানো স্বরের মৃদু আহবানে সচকিত হয় মেয়েটা।
গলির মোড়ে বহুতল বাড়ির রাতের দ্বাররক্ষী,
স্বজনহীন শহরে মাঝে সাঝের সঙ্গী, উৎসব রাতে তার মনেও রোমাঞ্চ;
‘আজ ছেড়ে দাও বাবু, শরীলটা ভালো নেই’।
‘চল না পয়সা পাবি তো’, প্রথমে অর্থের লোভ, তারপর মিনতি,
নারীসঙ্গের লোভে বাবুটিও আজ মরীয়া, ভিখিরি মেয়েটার অসম্মতি অসহ্য তার কাছে
‘কি রে কানে যাচ্ছে না কথা, কিসের গুমোর এতো?’ চাপা আক্রোশে গজরায় লোকটা,
‘বলেছি তো আজ নয়; ছেলেটাকে ঘুম পাড়িয়েছি বহুকষ্টে, যাও তুমি’,
‘ছেলে? আজ আছড়ে মারব তোর ছেলে!’ ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মত তেড়ে আসে প্রবৃত্তির দাস।
নিমেষে বদলে যায় প্রেক্ষাপট,
‘ছুঁয়ে দেখো খোকাকে আমার!’ থান ইট হাতে রুখে ওঠে শান্ত মেয়েটা,
উন্মত্ত চোখের দৃষ্টি, শাড়ির আঁচল আলুথালু, রুখু খোলাচুলে সে আজ ভীষণা;
পিছুহটে বলিষ্ঠ দানব, ঔদ্ধত্ত নয় চোখেমুখে শুধুই আতঙ্ক।
উৎসবরাত্রি পূর্ণ হয় অবশেষে,
অমানিশার ঘোর অন্ধকারে, জেগে ওঠেন দানবদলনী দেবী মহা কালরাত্রি।


***   

বৃহস্পতিবার, ২৯ অক্টোবর, ২০১৫

তুলসী বিবাহ

পূব আকাশের ধুসর চাঁদোয়ায় সবে লেগেছে ফাগুনের আবির,
পাতালরাজ্য সুষুপ্তির অন্ধকারে;
দীপের আলোয় জেগে উঠেছে শুধু একটি কক্ষ।
পাতালপুরীর রাজদেবালয়ে পূজোয় বসেছেন রানী বৃন্দা,
সম্মুখে শ্রীবিষ্ণুর স্বর্ণমূর্তি স্মিত আলোয় উদ্ভাসিত।
পরনে পবিত্র কাষায় বস্ত্র, অঙ্গে অলঙ্কার সামান্যই;
কপালে অলকা তিলক,রাজেন্দ্রাণীর সমাহিত রূপ শ্রদ্ধা জাগায়।
লঙ্কাপতির মামাতো ভগ্নি, কালনেমি পুত্রী, পাতালরাজ জলন্ধর মহিষী,
তবু বিষ্ণুসেবিকা এই পরিচয়েই তিনি ধন্যা।
ভক্তিতে একনিষ্ঠ, সতীত্বে উজ্জ্বল নারীশ্রেষ্ঠা সুন্দরী বৃন্দা –
রাক্ষসকুলে জন্মেও নারায়ণ কৃপাধন্যা;
পত্নীর সতীত্ব তেজে বলীয়ান অনার্য জলন্ধর ত্রিভুবনে অপরাজেয়।

পাতাল নৃপতি জলন্ধর মানতে চায়না আর্যকুলের শ্রেষ্ঠত্ব,
জন্মসূত্রে নয়, পুরুষাকারেই অর্জিত যে তাঁর সার্বভৌমত্ব;
অনার্য রাজার স্পর্ধায় বিস্মিত ইন্দ্র, সুরাসুর যুদ্ধ দেখা দেয় অনিবার্যরূপে।
যুদ্ধ অসম, তবু জয়ী হয় বীর জলন্ধর, নিজ বাহুবলে;
পরাজিত, ভীত, দেবকুল আশ্রয়প্রার্থী কৈলাসধামে, মহাদেব ভরসা তাঁদের।
যুদ্ধ শুরু হয় অসম্ভবের, দিবারাত্রি রনডঙ্কায় দশদিক প্রকম্পিত;
অটল নিজ বিশ্বাসে বৃন্দা সুন্দরী শুধু অবিচলিত –
বিষ্ণু আশীসে সে যে চিরায়ুষ্মতী।

উজ্জ্বল মশাল জ্বলে চতুষ্কোনে, দীপদন্ডে সহস্র মঙ্গলদীপ,
রাত্রি মধ্যযাম গত, তবু সুরলিত বিষ্ণুমন্ত্রে মুখরিত পুজাগৃহ;
অখন্ড উপাসনারত সতী বৃন্দা, বিজয়ী স্বামীর আগমনেই করবে আসন ত্যাগ।
‘প্রিয়ে’ অতিপরিচিত স্নেহ সম্বোধনে চোখ মেলে রানী, স্মিত হাসি জাগে ওষ্ঠাধরে,
সম্মুখে বিজয়ী জলন্ধর দুবাহু বাড়িয়ে, দীর্ঘ বিচ্ছেদ শেষে চোখদুটি মিলনে উন্মুখ।
প্রিয় বাহুপাশে কয়েক মুহূর্ত অনন্তকাল সম, ওষ্ঠাধর পুলকিত গভীর চুম্বনে,
আসঙ্গসুখে মুদে আসে আঁখি, অনুরাগে রাঙা মুখ প্রস্ফুট গোলাপ,
‘তুমি সুখী প্রিয়ে?’ গভীর প্রণয়ে চোখ মেলে চায় বৃন্দা স্বামী মুখপানে।
আচমকা গর্জায় মেঘ ডমরু নিনাদে, নিভে যায় মঙ্গলদীপ সহস্র বাতিদানে,
ক্ষনপ্রভা বিজুরী আলোকে আলিঙ্গনপাশে বেঁধেছে সতীকে কে ও?
‘বিষ্ণুদেব!’ আর্ত চিৎকারে কেঁদে ওঠে পরম সাধিকা,
জলন্ধর শির ছিন্ন হয় ত্রিশূল আঘাতে কৈলাস ধামে;
নিষ্ঠুর উল্লাসে মাতে স্বর্গলোক, জয়ী হয় দেবত্ব নারীত্বের চরম অপমানে।

‘তোমাকে পূজেছি চিরকাল কায়মনে, এই তার পুরষ্কার?’
পাষাণমূর্তি সম বৃন্দার আক্ষেপ বিচলিত করে পুরুষশ্রেষ্ঠকে,
‘জগৎ কল্যাণ হেতু দায়বদ্ধ আমি ক্ষমা কর দেবী’ -
আত্মপক্ষ সমর্থনের নির্লজ্জ প্রচেষ্টায় বিড়ম্বিত স্বয়ং নারায়ণ।
‘আমি সামান্যা রাক্ষসী, দেবী নই, ক্ষমায় অপারগ,
পাষাণ-হৃদয় হরি, আভিশাপে মোর পাষাণে আবদ্ধ হবে তুমি,
যে কলঙ্কের কালি মাখালে আমায় আজি, সেই ঘোর কালো লাগুক তোমার অঙ্গে,
বিরহ, লাঞ্ছনা যত দিয়েছ আমায়, পাবে শতগুণে তুমি মানব জনমে’।
মশাল আলোকে যজ্ঞাগ্নি জ্বেলে, ঝাঁপ দেয় লাঞ্ছিতা বিরহিণী,
সাক্ষী থাকে দেব চরাচর।

বৃন্দার চিতাভস্ম জ্বালায় তুষাগ্নি মহেশ্বরের কোমল অন্তরে,
পবিত্র তুলসী বৃক্ষে পায় প্রাণ সতী বৃন্দা তাঁরই আশীষে;
‘কলঙ্কিনী নয়,বিষ্ণুপ্রিয়া হবে তুমি তুলসী সুন্দরী’, জানান বিষ্ণু অতঃপর।    
শালিগ্রাম শিলা রূপী নারায়ণ সাথে তুলসী বিবাহ ঘটে কার্ত্তিক একাদশীতে,
নারীত্বের অমর্যাদাপাশে বাঁধা পরেছেন পুরুষোত্তম চিরতরে,
তাই কি আজও সম্বৎসর,ঘটে তাঁর কলঙ্কমোচন তুলসী বিবাহে?

***

@অনন্যা পাল ২০১৫

মঙ্গলবার, ৬ অক্টোবর, ২০১৫

আশ্রয়

ঘরের লাগোয়া ব্যলকনিটা তার বড় প্রিয়।
সেই কোন ছেলেবেলায় বাবা মায়ের হাতধরে এই ফ্ল্যাটে উঠে আসা,
‘আজ থেকে এটাই আমাদের বাড়ি, আর এই ঘরটা তোমার’ –
কথাটা শেষ না হতেই, একছুটে পৌঁছে গেছিল নরম রোদ মাখা বারান্দাটায় ছোট্ট তিন্নি,
‘আর এটা?’ ‘এটাও তোমার’ বাবা হেসে কোঁকড়া চুলগুলো ঘেঁটে দিয়েছিলেন পরম আদরে।
সেই থেকে, বাড়ির এই বাড়তি কোনাটা তার একমুঠো আকাশ আর চিলতে রোদকে সঙ্গী করে
হয়ে ওঠে তিন্নির বড় আপনার,
একা একা এক্কাদোক্কা খেলা, গল্পের বইয়ে পাতায় হারিয়ে যাওয়া;
আর তারও পরে, লাল বাঁধাই খাতায় কবিতার আঁকিবুঁকি  –
এর সবকিছুই যে ওই বারান্দার নিশ্চিন্ত ঘেরাটোপে,
এই টুকরো জায়গাটুকু তার একান্ত নিজের,
যার ভাগ দেওয়া যায় না কাউকে।

রাস্তার ধারের কৃষ্ণচূড়া গাছটা ছায়া ফেলে বারান্দার রেলিঙে,
বাতাসে শুষ্কতার শিরশিরানি যেন আসন্ন শীতেরপূর্বাভাস;
সামনের পার্কটাতে পাঁজরা বের করে দাঁড়িয়ে আছে প্যন্ডেলের কাঠামো
উৎসব শেষে, হত-গৌরব ভাঙা দেউলির মত।
গাছের ডালে বসা কাকটাকে হুড়ো দিতে গিয়ে হেসে ফেলে তিন্নি,
এই চুয়াল্লিশে এসব বোধহয় মানায় না;
মানায় না তো আরও কতকিছুই -
ব্যাবসায়ী স্বামীর সাফল্যের চেয়ে তার ব্যভীচারকে বড় করে দেখা,
ছেলেটার ভবিষ্যৎ না ভেবেই এক কাপড়ে তেজ দেখিয়ে বেরিয়ে আসা।
বুড়ো বাপ মার কাছে ফিরে এসে সেই বাড়িটায় ওঠা, যা সে নিজের বলেই জানত,
ভারি বেমানান সেটাও আজ সকলের চোখে।
একটা দীর্ঘশ্বাস বাতাস ভারী করে দেয় আচমকা,
খর হয়ে ওঠে কার্তিকের নরম সকাল।

একটু পরে আসবে কোন্নগরের পিসি ডাক্তার গৃহিণী মেয়ে নিয়ে,
উপলক্ষ বিজয়ার শিষ্টাচার,তবে লক্ষটা যে তিন্নি সেটা সহজবোধ্য;
স্কুলের সব পরীক্ষায় এগিয়ে থাকা তিন্নিকে পেছনে ফেলে,
লাল টিপ আর জামদানীতে ঝলমলে ছোট বোন এখন ডার্বি জেতা ঘোড়া;
গলার কাছে দলা পাকিয়ে ওঠা কষ্টটাকে পেছনে ঠেলে দিতে গিয়ে ভেজে চোখ।
‘কা কা’ হেড়ে গলার হুঙ্কারে যুদ্ধের আহ্বান জাগিয়ে
প্রতিবাদী কাকটা রেলিঙে এসে বসে,
না চাইতেই ঠোঁটের কোন বেঁকে যায় হাসিতে,
কাকটার সাথে গলা মেলায় চুয়াল্লিশের তিন্নি,
ঝিরি ঝিরি বাতাসের দোলায় খসে পরে পাতা ঝুরো চুলের এলমেলো সিঁথিতে।
বারান্দাটা নতুন করে বড় কাছের মনে হয়,
শৈশবের স্বপ্নমাখা, নিশ্চিন্ত আশ্রয়।

***
অনন্যা পাল
৭ই অক্টোবর, ২০১৫

সোমবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

লুটের বাতাসা

মেয়ের বিদেশী স্কুলে কমিউনিটি সার্ভিস তথা নানা সমাজসেবামূলক কাজকর্ম হয়ে থাকে, সেসব কাজের জন্য অর্থের যোগাড়ও হয়ে থাকে বিভিন্ন উপায়ে; যথা নানান অনুষ্ঠান (ডান্স পার্টি, থিয়েটার ইত্যাদি), সর্বোপরিসেলএ জামাকাপড় বিক্রি থেকে এইসেলব্যপারটা ভারি জনপ্রিয় এবং প্রতিবারই নির্ধারিত দিনে অভিভাবকেরা যেরকম মরীয়া হয়ে সমাজসেবায় ছুটে আসেন, তা সত্যিই হৃদয়স্পর্শী

আমরা তখন ঢাকায় সদ্য এসেছি, স্কুলে নতুন; খবর পেলাম এরকম একটি সেলের। মেয়ের সহপাঠিনীর মা, ভারী উপকারী, নিজে থেকেই উৎসাহ দিলেন, ‘দুশো টাকা রেটে ঢালাও প্যান্ট, জামা, ড্রেস, এমনকি গরম জামা পর্যন্ত; সব ভালো ভালো ব্রান্ডের’ আমাকে এর বেশী বলার প্রয়োজন হোলনা, সমাজসেবার মহৎ উদ্দেশ্যে ততক্ষণে আমি অদম্য যাইহোক, নির্দিষ্ট দিনে সময়ের বেশ কিছু আগেই বেরিয়ে পরলাম নিমরাজি মেয়েকে বগল দাবা করে; ওকে সঙ্গে নেবার মুল উদ্দেশ্য ভীড়ের মাঝে বোঁচকা সামলানো, মুখে অবশ্য বললাম, ‘নিজে পছন্দ করে নিতে পারবে, ভালো হবে না?’ পৌঁছে দেখি হলের বন্ধ দরজার সামনে কাতারে কাতারে জন সমাবেশ; আকৃতি, প্রকৃতি, বর্ণ, জাতির বৈচিত্রে মিল শুধু একটাই, হাতে সকলেরই বড় বড় ঝোলা। বুঝলাম, এ বড় শক্ত ঠাঁই; ‘চোখ, কান খোলা রেখো’ মেয়েকে সতর্ক করে রেসের ঘোড়ার মত তেরিয়ে রইলাম দরজা খোলার অপেক্ষায়। এভাবে কাটল বেশ খানিক্ষন, স্বাভাবিক নিয়মেই একটু আলগা হয়েছে আমার তৎপরতা; অমনি আচমকা খুলে গেলো গুপ্তধনের গুহা। কিছু বোঝার আগেই প্রায় ভাসতে ভাসতে ঢুকে পড়লাম ভেতরে, ভাগ্যিস মেয়ের হাতটা ধরা ছিল তাই নিরুদ্দেশ ঘোষণার প্রয়োজন হোল না। তবে মুশকিল অন্য দিকে, ঢুকে তো পড়লাম, কিন্তু থামা দায়। এ টেবিল, ও টেবিল পেরিয়ে স্রোতে ভাসতে ভাসতে উপায় না দেখে শেষে একখানা টেবিল ক্লথ প্রানপনে খামচে ধরলাম। যাক, এবার থামা গেছে ভেবে সুস্থির হবার আগেই, ‘এক্সকিউস মি’ তীক্ষ্ণ হুংকারে চমকে দেখি, টেবিল ক্লথ নয়, আমি এক শ্বেতাঙ্গিনীর সাদা ফ্রকের কোনা চেপে ধরে আছি। কোনমতে ক্ষমা চেয়ে তেড়ে গেলাম সামনের টেবিলে ঢাঁই করে রাখা টিশার্টের দিকে।একটা বেগুনী টপ চোখে লাগল, হাত বাড়াতেই একটা থাবা নাকের ওপর দিয়ে সেটা উড়িয়ে নিয়ে গেলো; এরপরে লাল, সবুজ, কমলা তাক করেও কোনটাই কব্জা করতে পারছি না। এবার একটা লেসের কলার ওয়ালা নীলচে টিশার্ট নজরে আসতেই প্রানপনে চেপে ধরলাম, টানবার আগেই এক ছ-ফুটিয়া লালমুখো তার আর এক দিক চেপে ধরল। সেও ছাড়বে না, আমিও হয় এসপার নয় ওসপার; খানিক চলল এই টাগ অফ ওয়ার, শেষে আমার গোঁ দেখে সাহেব রণেভঙ্গ দিলো, জয়ের উল্লাসে আত্মহারা আমি খেয়াল করলাম না টানাটানিতে সাধের কলার ভীতু কুকুরের কানের মত ছেতরে গেছে। এভাবে যুদ্ধনীতি খানিক রপ্ত হতে ঠিক করলাম বাছাবাছি পরে, আগে যা পাই ওঠাতে হবে; এ ব্যাপারে দেখলাম মেয়ে আমার থেকে চৌকশ, মিনিট দশেকের মধ্যেই খান কুড়ি জামা কাপড় বাগিয়ে ফেলল। যা হোক বাছাবাছির সুযোগ নেই, তাই মোটামুটি আন্দাজে সাইজ দেখে নিয়ে কাপড়ের বান্ডিল জড়ো করে এগোলাম কাউন্টারের দিকে। ভল্যান্টিয়ার হিসেব কষছেন, তাতেও শান্তি নেই; এক ক্ষীণতটি পীতাঙ্গীনি (সম্ভবতঃ টেবিলে টেবিলে বিশেষ সুবিধে করতে না পেরে) ফিরতি পথে আমার সংগ্রহে হাত বাড়িয়েছেন। ‘এক্সকিউস মি’ এবারে আমি হুংকার দিলাম অনেকটা ‘সিংহাম’ স্টাইলে।    

ব্যাগ বোঝাই ও পকেট হালকা করে বাড়ি ফিরে সদর্পে পসরা খুলে বসলাম; উদ্দেশ্য আমার বিচারবুদ্ধির ওপর সম্পূর্ণ আস্থাহীন বাড়ির কর্তাটিকে তাক লাগিয়ে দেওয়া। প্রথমেই দুটো টপ বেরোল, একটা মেয়ের বছর দুয়েক আগেকার সাইজ, অন্যটাতে মা মেয়ে দুজনে একসাথে ঢুকে যাওয়া যাবে। এ ভাবে কোনটার বিটকেল আকৃতি, কোনটার বা উৎকট রঙ মোটের ওপর আমার মত অতি উৎসাহীর ও কাছাখোলা অবস্থা। ‘হরির লুটের বাতাসা, মন্দ কি!’ কথাটা হাওয়ায় উড়িয়ে আমার স্বল্পভাসী পতিদেব ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন; যেতে যেতে যে খিঁকখিঁকে হাসিটা উপহার দিয়ে গেলেন, মনে হোল একশটা ডেঁয়ো পিঁপড়ে একসাথে কামড়ে দিলো।   
  

***

শনিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

উত্তর মেলেনি

প্রায় দুযুগ আগের কথা, হয়নি বেশিদিন বিয়ের;
ব্যস্ততার জীবনে হঠাৎ পাওয়া ছুটিতে দুজনেই উচ্ছ্বল -
ঠিক হোল যাব দীঘা, বাঙালীর আটপৌরে গন্তব্যস্থল।

দূরপাল্লার বাসে দিলাম পাড়ি,
হালকা শীতের আমেজে আসন্ন উৎসবের আভাস,
বয়সটাও ভালো লাগার;
ছুটির দুটো দিন পাখনা মেলে উড়ে গেল স্বপ্নের ঘোরে।

ফেরার দিন একটা সুখস্মৃতি, কিছুটা বিষন্নতা আর একরাশ ঝিনুকের গয়না ব্যাগবন্দী করে হাজির হলাম বাসস্ট্যান্ডে।
ছুটিফেরতা যাত্রিদের ভীড়ে জায়গাটা সরগরম,
টিকিট পেলাম বটে, তবে প্রায় পেছনের সীটে।
পছন্দের জানলার ধারে বসে, শেষবার দেখে নিচ্ছি বাইরেটা -
বাস ছাড়বার মুখে।

হঠাৎ একটা হৈচৈ, কিছু বোঝার আগেই বাসে উঠে পড়ল এক যুবতীসহ জনা চারেক যুবকের একটা ছোট দল।
শেষ মূহুর্ত্তের টিকিট, কন্ডাক্টর দেখিয়ে দেয় ইঞ্জিনের পাশের চিলতে বেঞ্চ -
বাস কর্মচারীর নির্ধারিত সীট, যা ভীড়ের দিনে যাত্রীদের শেষ ভরসা।
'এয়ার্কি আরকি, আমি বসবো এখানে?' মহিলার স্বরে অমার্জিত ঔদ্ধত্ব,
'আপনি লাস্ট সীটে চলুন, হয়ে যাবে যা হোক করে,
গোবেচারা কন্ডাক্টর আপোশ-উন্মুখ।

'আমি একা বসবো! এরা কি মাগনা উঠেছে বাসে?'
যুবতীর তিরষ্কার জাগিয়ে দেয় সঙ্গীদের পুরুষাকার অচিরেই;
ফলস্বরূপ সীটচ্যুত হয় শেষের সারির কয়েকজন,
এক বৃদ্ধ অসম্মতি জানিয়ে খান গলা ধাক্কা -
বাদ যায় না কন্ডাক্টার ও, সপাট চড় নেমে আসে তার গালে, বৃদ্ধের হেনস্থার প্রতিবাদের জেরে।
বাকী যাত্রীরা সমাহিত হয় নির্বেদ স্তব্ধতায়,
হয়ত ছাপোশা বাঙালীর এ এক অসহায় আত্মনির্যাতন।

বাস চলতে শুরু করে, তার সাথেই শুরু হয় পেছনের সীটে নির্লজ্জ প্রমদ-উল্লাস;
মক্ষীরানিকে ঘিরে চার যুবকের অমার্জিত কথাবার্তায় শিউরে উঠি,
মননিবেশ করি পথসঙ্গী হাতের বইটিতে।

কোলকাতা আসতে আর নেই বেশী দেরী, বাস থামল একটি পেট্রল পাম্পে;
ট্যাঙ্কে ইন্ধনপূর্তী, সাথে ক্ষনিক জলপানের বিরতি।
সকলেই প্রায় নেমেছে বাস থেকে, জল না হোক খোলা বাতাসই বা কম কি?
নেমেছে যুবতীর তিনসঙ্গী,
থেকে গেছে একজন, বুঝিবা একাকী সঙ্গলোভে।

আলগোছে জানলায় হাতরেখে চোখ রাখি সিঁদূরী আকাশে,
অস্তরাগের আভায় ছলকে ওঠে আমার তরুণ মন।
আচমকা কাঁচের পাল্লাটা ঝাঁপিয়ে পড়ে হাতের আঙুলে,
প্রচন্ড ব্যাথায় সরিয়ে আনি হাত,
চোখে জল আসে তীব্র আঘাতে।
'জানলাটা বন্ধ করলি কেন?' যুবক ধমকে ওঠে ক্ষনপূর্বের প্রণয়িনীকে,
তার কর্কশতায় থমকে যায় উদ্ধত যুবতী।

'খুব লেগেছে আপনার? একটু জল দেবেন হাতে?' প্রশ্নটা আমাকে,
যুবকের প্রশ্নে স্পষ্ট উদ্বেগ, কোমল ব্যঞ্জনায় আফসোসের ছোঁয়া
বিস্ময়ে বাক্যহারা আমি মাথা নেড়ে অসম্মতি জানাই।
বাকি রাস্তা মেয়েটি নিশ্চুপ,
আমার মনেও বিস্মিত জিজ্ঞাসা।

এরপর কেটে গেছে বহূকাল,
জীবনের পরোতে পরোতে জমেছে অভিজ্ঞতার পলি;
তবু সেদিনের অসঙ্গতির  আজ ও উত্তর মেলেনি।

***

সোমবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

প্রতীক্ষা

ছোট্ট বুক রোমাঞ্চে দুরুদুরু,
গ্রীলের ফাঁক দিয়ে চেয়ে আছে দুটি সরল চোখ অসীম আশায়;
পুজোর আর কটা দিন বাকি -
অফিস ফেরতা পথে বাবা আনবেন পুজোবার্ষিকী।

গরমের ছুটির নির্জন দুপুরে,
দরজায় কান পেতে থাকা পিওন কাকুর অপেক্ষায়,
আসবে কি আজ চিঠি প্রিয় বান্ধবীর -
কিশোরী মনের উচ্ছাস  যার পাতায় পাতায়?

ফোনের আওয়াজ কানে যেতেই পাদুটো বশে থাকেনা আর,
দৌড়ে গিয়ে রিসিভার তুলে 'হ্যালো'?
এটা মেজমাসী, ফোনটা মায়ের;
পরেরটা ঘোষ কাকু, দরকার বাবার সাথে,
আসে পড়ুয়া বন্ধুর ফোন, অথবা নেহাৎ গল্প বিলাসী।
আশা নিরাশার দোলচালে তবু চলে অনন্ত প্রতীক্ষা,
আজো কি যাবে না শোনা সেই চেনা ডাক - পরবাসীর?


শ্রাবণ ঘন সন্ধ্যা, বাইরে মনকেমন করা চাপচাপ অন্ধকার;
মনের উচ্ছ্বাস তবু বাঁধ মানেনা আর,
বহুদিন পরে আসছে মেয়েটা,
গাড়ীর আওয়াজ হলো কি - এত দেরী কেন?
সময়ের হিসেব হারায় আমার মাতৃহৃদয়ের অধীরতা।


রাত্রি নিশুত, বিছানার পাশে বসে আয়া মেয়েটি ঢুলছে,
আজ কি পূর্ণিমা? রূপোলি জোছনা, জানলার পর্দাকে ফাঁকি দিয়ে আলতো ছুঁয়ে আছে আমায়;
কি শান্তি! এখনো কি হয়নি সময়?
আমি যে পথচেয়ে আছি প্রিয়তম -
চিরমিলনের আশে এ আমার শেষ  প্রতীক্ষা।


@ananyapal2015