মঙ্গলবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১৭

একটি রূপকথা

সে অনেক কাল আগের কথা, এক ছিলেন রাজা চন্দ্রকেতু, প্রকৃতির কোলে শস্য শ্যামল তাঁর রাজ্য আনন্দপুর রাজ্যে কোনও কিছুরই অভাব নেই, প্রজারা সুখী, খুশী রাজকর্মচারীরাও রাজা মশাই বড় ভালো মানুষ, পরের সুখেই তাঁর আনন্দ তবু এর মাঝেই রয়েছে একটা ছোট্ট অস্বস্তি; রাজা যুবক, দেখতে শুনতেও ভালই, কিন্তু তাঁর গায়ের রঙ বেজায় কালো এই রঙ নিয়ে তাঁর মনে যত সংশয়;  কালো রাজা না জানি কত হাসির পাত্র সংশয় এমন যে রাজ প্রাসাদে না আছে কোনও আয়না, না কেউ পরে কালো রঙের কাপড়; এমনকি, রাজার সামনে মন্ত্রী, আমলা কেউ কালো কথাটাও ব্যবহার করে না পাছে রাজা দুঃখ পান এইত সেদিন রাজদরবারে সভাকবি সুর করে ধরেছেন তাঁর নতুন কবিতা,-

‘আমার মন প্রাণ সব চুরি গেছে আজ,
আমি গোয়ালিনী অবলা;
শ্যাম নাম জপী সারা দিনমান,     
চুরি করে কোথায় পালালে ‘শালা’!’

গান শুনে রাজা মশাই ভ্যাবাচ্যাকা, কবির মুখ কাঁচুমাচু; আর বাকি পারিষদের ঠোঁটে মুচকি হাসি আসলে কবিবর লিখেছিলেন কোথায় পালালে কালা কিন্তু গাইতে গিয়ে তড়িঘড়ি ভুল শোধরাতে শেষে শ্বশুর পুত্রকে স্মরণ

এতো গেল রাজসভার কথা, রাজ্যের বাইরে যেতেও রাজার ভারি সঙ্কোচ কদিন আগে প্রতিবেশী রাজ্য হুতোমপুরের রাজকন্যের স্বয়ম্বরের এলো নেমন্তন্ন; মেয়ের বাপ কতো বিনয় করে চিঠি পাঠালেন; সুশীল, ধনবান, তার ওপরে একটাও বিয়ে হয়নি এখনও, এমন জামাই পেতে কোন রাজাই না চান! কিন্তু তাতে কি, রাজা চন্দ্রকেতু অম্লশূলের বাহানায় নেমন্তন্ন ফেরত দিলেন; সুন্দরী রাজকন্নে, এতো রাজার মাঝখানে যদি কালো মুখ দেখে ঠোঁট বেঁকায়!

দিন যতো যায় মন্ত্রীরা চিন্তায় পরেন, রাজ্যে একজন রানীর প্রয়োজন নতুবা বংশলোপের সম্ভাবনা অবস্থায় রাজবয়স্য অনেক মাথা চুলকে, নস্যি সেবন করে সকাল সন্ধ্যে তামুক ফুঁকে একটা বুদ্ধি বের করলেন একদিন রাজাকে একা পেয়ে কথাটা পেড়েই ফেললেন, ‘আমি বলি কি মহারাজ, রাজকন্যেতে কাজ নেই আপনি বরং বেশ একটি সাদামাটা দেখে রানী আনুন ঘরে পার্বতী বিনে ভোলানাথকে কি মানায়? তোমার বক্তব্যটা কি হে ঘণ্টেশ্বর? একটু সোজা কথায় বল আজ্ঞে, আমাদের প্রধান্মন্ত্রীমশাই; তাঁর ধরুন গিয়ে মা ষষ্ঠীর কৃপায় গণ্ডা খানেক কন্যা, আর চেহারাপত্র তাদের বাপের মতই হেঁ হেঁ অতএব হবু স্বামীর চেহারা নিয়ে তাদের কোনও মাথাব্যাথা হবেই না (প্রসঙ্গতঃ প্রধানমন্ত্রী দেবদূত বর্মাকে তাঁর চেহারার কারনে আড়ালে লোকে যমদূত বলে ডাকে) কথাটা শুনে রাজার চোখের দৃষ্টি ঘন হয়ে এলো, আমি বোধহয় এখন সকলের দয়ার পাত্র তাই না? সেকি মহারাজ, না না! ঘণ্টেশ্বর লজ্জা পেয়ে পালাতে পথ পেলেন না

***

এক চৈতালি পূর্ণিমার সন্ধ্যেয় রাজা বিশ্রাম করছেন তাঁর রম্যদ্দানে; যূথী-মালতীর গন্ধে চারিদিক মাতোয়ারা, দখিনা বাতাসে শীতলতার আভাস হঠাৎ ভারি মিষ্টি নারীকণ্ঠের গান ভেসে এলো কিছু দূর থেকে, এতো গান নয় যেন সুরের মূর্ছনা চন্দ্রকেতু মন্ত্রমুগ্ধের মত এগিয়ে গেলেন গান লক্ষ করে বাগানের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে একটি নালা, নালার ওপর কিছু দূরে দূরে বাঁধা আছে মনোরম কাঠের পুল, আর তার চারপাশে নানান ফুলের গাছ এমনই একটি পুলের ধারে বকুল গাছের নীচে বসে আছে এক পরমা সুন্দরী মেয়ে; আকাশের চাঁদ হার মেনেছে তার  মুখশ্রীর লালিত্যে, সোনার বরণ মেয়ের রঙের ঔজ্জ্বল্যে জোৎস্নাও ম্লান। রাজা খানিক অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন রূপসীর দিকে, তারপর হঠাৎ সঙ্কুচিত হয়ে পরলেন নিজের কারনে তিনি ফিরেই যাচ্ছিলেন নিঃশব্দে, কিন্তু গানের কথা তাঁকে আটকাল

‘শ্রীমতী ভোলে শাসন বারণ কানুর দেখা পেলে -
ফুল ভোলে তার রূপের গুমোর ভোমরা কাছে এলে
কালো আঁখি ঢলঢল বাড়ায় মুখের শোভা –
চাঁদের আলোয় কালো বরণ বড়ই মনোলোভা।'

গান কি তাঁকেই শুনিয়ে গাইছে মেয়ে? একি কোনও ছলনা না মনের ভুল? এতো সব ভাবনার মাঝেই সে মেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে সামনে, হাতে তার বকুল ফুলের মালা

‘কালো-সাদা, রাত-দিন; একে মধ্যে অন্যে লীন  
আমার আলো ফুটবে কি গো তোমার আঁধার বিন?’

মালা দিয়ে রাজাকে বরণ করে নেয় দেবদুত বর্মার একমাত্র রূপবতী গুণবতী মেয়ে কাঞ্চনমালা; ঘণ্টেশ্বরকে উশ্কে রাজার কাছে পাঠনোর বুদ্ধি সেই দিয়েছিল তার বাবাকে   
এরপর ধুমধাম করে রাজার বিয়ে হল, আমার কথাটি ফুরলনোটে গাছটি মুড়ল

***

শুক্রবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

ম্যাসাজ মহিমা

ব্যাংককে থাকতে যাচ্ছি জানালে প্রথমেই যে কথাটা সবাই বলে ওঠে, তা হোল ‘আরে ম্যাসাজের জায়গা, খুব ভালো’, শুনে শুনে মনে হতে লাগলো যেন ওদেশে কাজকর্ম শিকেয় তুলে, খালি ম্যাসাজ করালেই চলে। অবশেষে একদিন সুবর্ণভূমি এয়ারপোর্টে পৌঁছানো গেলো, দেখি ভাষা না বোঝা গেলেও লোকজন খুবই কর্মনিপুণ; চটপট ইমিগ্রেশান, লাগেজ পেরিয়ে এগোতেই চোখে পড়ল সারথী হাজির হাতে প্ল্যাকার্ড ও মুখে হাসি নিয়ে। গাড়ীতে উঠতে, আধো আধো ইংরেজী বুলিতে সে জানিয়ে দিলো গাড়ীর সিটে ম্যাসাজের ব্যবস্থা আছে; আমি চমৎকৃত, এ  যে সত্যিই ম্যাসাজের দেশ! কদিন নানান কাজের ব্যাস্ততা পেরিয়ে এক রোববারের সকালে কর্তা বললেন, চলো ম্যাসাজ করাতে যাই আজ। রাস্তার মোড়ে মোড়ে পান বিড়ির দোকানের মত সারি সারি ম্যাসাজ সেন্টার সুকুম্ভিতে (আমরা ওখানেই থাকি), যা হোক, তাও কাছেই একটা বড় সেন্টার আসতে যেতে চোখে পড়ে, বললাম ওটাতেই যাই চলোসেন্টারের রিসেপশনে বসা মহিলা মিষ্টি হেসে প্রায় এনসাইক্লোপেডিয়ার মত গোবদা একটা রংচঙে বই ধরিয়ে দিলেন, পড়াশোনা করতে হবে ভেবে ঘাবড়ে যাচ্ছি, পাতা খুলে বুঝলাম এ হোল ম্যাসাজনামা। খুঁজে পেতে তার ভেতর থেকে একটা কাঁধের ম্যাসাজ পছন্দ করলাম (আমার একটি কাঁধ বেশ কিছুদিন ধরেই জমাটবদ্ধ), কর্তা নিলেন সনাতনী ম্যাসাজদুজনকে একসাথে নিয়ে গেলো একটা কেবিনে, সেখানেও হাসি মুখে দুই মহিলা কাপড় বদলে শুয়ে পড়তে বললেন। আমার তো কাঁধ, শুতে হবে কেনো ভাবছি, ভাষার বিভ্রাটে জিগ্যেস করার উপায় কোথায়! ঝামেলায় না গিয়ে শুয়ে পড়তেই,যা শুরু হোল তার সাথে ধোবিঘাটের কাপড় নিঙরানোরই কেবল তুলনা করা চলে; না আর একটা তুলোনাও খাটে। বাবা রামদেব টিভি চ্যানেলে স্বেচ্ছায় যেসব শরীরী মারপ্যাঁচ করে থাকেন, আমাদের নিতান্ত অনিচ্ছুক হাত পা গুলোকে নিয়ে ঠিক সেসবই করা হতে থাকলো; তবে হ্যাঁ মহিলাদ্বয়ের মুখের অমায়িক হাসিটুকু কিন্তু লেগেই ছিল সর্বক্ষণ। ঘন্টা খানেক ধরে চলল এই কোস্তাকুস্তি, আমার তখন মুখ দিয়ে আওয়াজ বের করারও ক্ষমতা নেই, হাত পা গুলো আর নিজের বলে ভাবতে পারছি না। অবশেষে গরম সেঁক (মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা টাইপ) দিয়ে শেষ হোল ম্যাসাজ। কম্পমান কলেবরে রিসেপশনে ফিরতে ধরিয়ে দেয়া হোল ভেষজ চা। মিথ্যে বলব না, চা টা খেয়ে বেশ ফুরফুরে লগলো, সেন্টার থেকে বেরিয়ে হাঁটতে গিয়ে দেখি শরীরটাও লাগছে ভারি ঝরঝরে। ঘরে ফিরে কর্তা বললেন, ‘আবার যাবে তো?’ আবার যাবার সাহস হবে কিনা জানিনা, তবে শ্যামদেশীয় (থাইল্যান্ড) আড়ং ধোলাইয়ের যে মহিমা আছে সেকথা স্বীকার করতেই হোল।


***

©1917 ananyapal ALL RIGHTS RESERVED

শুক্রবার, ২৫ আগস্ট, ২০১৭

ছাড়া কি যায়?

আমার ঢাকার বাড়ির বারান্দায় আলো আঁধারির ছায়া ফেলে ঝুঁকে আছে যে গাছটি,
বহুকালের চেনা বন্ধুর মতই তার উপস্থিতি , আমার এই তিনবছর ব্যাপী প্রবাস জীবনে;
নাম জানতে চাইনি কখনও, নামে কি বা আসে যায়?
গ্রীষ্মের দখিনা বাতাসে তার পাতায় ঢেউ, আমাকে ছুঁয়ে যায় আলতো আলিঙ্গনে,
বাদলা দিনের একলা দুপুরে সিক্ত পরশে সে জানায়, ‘পাশেই আছি’,
মন উঁচাটন বসন্তদিনে ডালপালা দুলিয়ে হাতছানি দেয় পরম আদরে।
আজ যাবার দিনে, তার চিকণ পাতার নরম সবুজে রয়ে যাবে আমারও একটু খানি,
ছাড়তে চাইলেই ছাড়া কি যায়?

গাছের ডালে, বারান্দার কার্নিশে নিত্য তার আনাগোনা, গলায় সাদা দাগ,
গল্পপ্রিয়, প্রতিক্রিয়াশীল এক বাঙ্গালিনী কাক;
আমার মত সেও একটি মেয়ের মা, মাতৃত্বের অনেক কিছু শিখেছি তার কাছে।
ছটফটে, চটপটে একজোড়া বুলবুলি, দূপুরের লেখালেখির মগ্নতার মাঝে,
পড়ার ঘরের কাঁচে, ঠোকর দিয়ে জানান দেয় গোপন অভিমানে,
আমারও আছি সাথে।
লক্ষ্মীমন্ত বেনেবউ কাঁচা হলুদ গা, হালকা পায়ে উড়ে বেড়ায় এডালে, ওডালে,
হোল না তো কমদিন, তবু আমার মুগ্ধতা আজও সেই প্রথম দিনের মতই।
চলে যেতে হবে সবাইকে ছেড়ে, তবু নিঃসঙ্গ দিনে আলো ছায়ার আঁকিবুঁকিতে, রয়ে যাব আমি;
ছাড়তে চাইলেই ছাড়া কি যায়?

চায়ের কাপ হাতে জানলায় বসলেই, দেখা যায় শ্যামলিমা ঘেরা বারিধারা ঝিল,
তার গহন গভীর জলে ডুব দিয়ে, কুড়িয়ে আনতে সাধ হয় জমে থাকা বহূযুগের কথা;
উজ্বল দিনে সোনা চিকচিকে ঢেউয়ে, পাল তোলে আমার সুদূর পিয়াসী মন।
ধ্যানগম্ভীর পূবের দিগন্তের গেরুয়া, ছুঁয়ে যায় আমার অন্তঃস্থল প্রতিদিন;
গোধূলির কোনে দেখা আলোয় দূরন্ত পশ্চিমী ক্যানভাস –
ধরে রাখি মনের লেন্সে ক্লান্তিহীন মুগ্ধতায়।  
আমি চলে যাব; তবু ঝিলের ঢেউ ছন্দহীন হবে না, সূর্যাস্তের রঙে আঁকা হবে নতুন কাহিনী;
শুধু আমার নিঃশ্বাস বাস্প, ভোরের শিশির হয়ে মূর্ত হবে জানলার কাঁচে;
ছাড়তে চাইলেই ছাড়া কি যায়?


***
©1917 ananyapal ALL RIGHTS RESERVED

শুক্রবার, ১১ আগস্ট, ২০১৭

জঙ্গল সাফারি ও গদাযুদ্ধ

কদিন আগে পতিদেব ও আমি জনা চারেক বন্ধু সমেত গেছিলাম কেনিয়ার জঙ্গলে; আমার জঙ্গলযাত্রা এই প্রথম, তাও একেবারে রোমহর্ষক মাসাইমারা, এযেন একলাফে গাছে ওঠা চারজনের মধ্যে দুজন বন্ধু ফোটোগ্রাফার; পতিদেবও ইদানিং ওইদলে নাম লিখিয়েছেন, অতএব সাফারি সফরের রোমাঞ্চ যে কি, সে বিষয়ে সম্বৃদ্ধ হতে হতে পৌঁছে গেলাম নাইরোবি এয়ারপোর্টে হাজির গাইড কাম ড্রাইভার কাকা (না আমার খুড়ো নয়), সাফারি জীপ সাথে নিয়ে; শুনলাম এই বাহনই সামনের সাতদিন হবে আমাদের পীঠস্থানও হরি, মাথাখোলা হাড়গিলে এই জীপে সারাদিন চেপে থাকলে পীঠের স্থানে কি অবশিষ্ট থাকবে ভেবে আমি ততক্ষণে হতভম্ব

যাইহোক, ভোর না হতেই প্রতিদিন বালিশ কাঁধে ফোটোগ্রাফারের দল (ওঁদের দাবি ওগুলো বিন ব্যাগ) জীপের পশ্চাদপট দখল করেন; বাকি দুই আনাড়ী সাথী নিরাপদ দূরত্বে সামনের দিকের সিটে, মুশকিল হোল আমাকে নিয়ে অবস্থার গতিকে আমাকে বসতে হয় ফোটোগ্রাফার দলের আওতার মধ্যে, পুরস্কার স্বরূপ কোনও জন্তু বা পাখী দেখলেই স্টপ স্টপবলে তারস্বরে চ্যাঁচানোর দায়িত্ব বর্তাল আমার ওপর চ্যাঁচ্যাঁতে আমি চিরকালই ওস্তাদ, কিন্তু গোল বাধল অন্য জায়গায় ফোটোগ্রাফারের দল গদাধারী ভীমের মত গদা, থুরী ক্যামেরা উঁচিয়ে সারাক্ষণ আস্ফালন করেন, একটা কিছু দেখা গেলো কি গেলোনা, তাঁদের রণহুঙ্কারে আমি তস্থ! একদিন ঝোপের ধারে দেখা মিলল সিংহমামার, একটা নয় গোটা তিনেক (জঙ্গল তো নয় মামারবাড়ী!); ফোটোগ্রাফার বাহিনী যথারীতি উত্তেজিত, নিজের মোবাইলে জানলা দিয়ে একটা ছবি তোলার চেষ্টা করতেই পতিদেবের গদারূপী ক্যামেরার বাড়িতে আমার ডান হাত অবশ এত নড়াচড়া করলে এই হয়স্বান্তনা বাক্য নয়, খ্যাঁকানি কানে এলো কিছুদূরে একটা সিংহছানা দেখে উত্তেজিত হয়ে দাঁড়াতে গেছি, ‘এ তো আচ্ছা বেকুব! লায়ন কাবের বদলে তোমার টুপীর ছবি নিয়ে বাড়ী যাব না কি?’ এক বন্ধু হুড়ো দিতে কাঁচুমাচু মুখে বসে পড়ি রাস্তার দুধারে দিগন্ত বিস্তৃত সাভানা ঘাসের ঢেউ, মাঝে মাঝে আকাসিয়া গাছ নয়নাভিরাম; এরই মধ্যে একটা গাছের মাথায় ঈগল দেখে যথারীতি স্টপবলে চেঁচিয়েছি গাড়ী থেমেছে কি থামেনি, বান্ধবীর ক্যামেরা তেড়ে এলো আমার মুখের ওপর ওরে মারা পড়ব যে!’, ‘সাফারিতে এসব একটু সহ্য করতে হয়’, আমার আর্তনাদের উত্তর মিলল একেই লগনচাঁদা মুখশ্রী, তায় গদাপ্রহারে তুবড়ে গেলে যে বেবুনরাও দলে নেবেনা, বোঝাই কাকে! এদিকে আর এক গেরো সামনে বসা দাদাকে নিয়ে, ভারি গোবেচারা দাদাটি ভালো কিছু দেখা গেছে কানে গেলেই উদ্ভ্রান্তের মত তাঁর দু-ফুটিয়া আইপ্যাডটি মেলে ধরেন; এভাবে তিনি ছবি কতদূর তুলতে পেলেন জানিনা, তবে গাড়ীর সামনের কাঁচ দিয়ে খালি চোখে কিছু দেখার আশাও আমায় ছাড়তে হোল একবার চিতা দেখা গেলো গাড়ীর সামনে, সবাই খুব উত্তেজিত; আমি অবশ্য আইপ্যাডের কালো ঢাকনার ওপর দুটো হলুদ কান দেখেই সন্তুষ্ট রইলাম সুখের কথা এই যে, দাদা আমার, সাফারিতে বেশীরভাগ সময় ঢুলেই কাটিয়েছিলেন

দুর্গম জঙ্গুলে রাস্তায় জীপের দোদুল দোলা, সাথে দুর্ধর্ষ ফোটোগ্রাফারদের জঙ্গী হামলা, এসব সয়ে জীবনের প্রথম সাফারি সফরের যে অভিজ্ঞতা আমার হোল, চাঁদের পাহাড়ে শঙ্করের অভিযানের থেকে তা কম কি সে! শুধু আমার অ-ফোটোগ্রাফার বন্ধুদের জন্যে একটা উপদেশ, ‘কুঁজোর চিৎ হয়ে শোয়ার চেষ্টা না করাই ভালো’; তারপরও নেহাৎ জঙ্গলে যেতে হলে সাথে বর্ম ও হেলমেট নিতে ভুলবেন না; আর হ্যাঁ বালিশও একটা নেবেন, না ছবি তুলতে নয়, পিঠে গুঁজতে কাজে দেবে  

***
©2017 ananyapal ALL RIGHTS RESERVED

মঙ্গলবার, ১৩ জুন, ২০১৭

আষাঢ়স্য প্রথমদিবসে

খোলা বাতায়ন পথে দখিণা বাতাস বয়ে আনে স্নিগ্ধ পরশ তন্দ্রাতুর অলস মধ্যাহ্নে,
নুয়েপড়া বৃক্ষশাখে রাঙা কিংশুক গুচ্ছ দোলে, সলজ্জ হরষে;
বুঝিবা বলতে চায় কিছু।
উদ্যান মাঝে যত্নে বাঁধানো পুষ্করিণী, শ্বেতপদ্ম ফুটে আছে তার নীল জলে,
বকুল বৃক্ষের ছায়াঘন প্রস্তর বেদিকা, ঝরা বকুলের সমারোহ সেথা,
যুথি,জাতি, মল্লিকা কুন্দফুলে উপবন, নন্দনকানন;
বাতাস মদির পুষ্প সৌরভে।

একাকী পুরুষ রয়েছেন বসে গবাক্ষ পাশে, অতিশয় কান্তিমান,
তপ্ত কাঞ্চন বর্ণ, দীর্ঘ, ঋজু দেহ, দেবতুল্য মুখশ্রী,
চোখদুটি কোমল, ভাবময়, না জানি বিভোর কোন মধুর কল্প লোকে,
উন্মুক্ত কাঁধে দৃশ্যমান উপবীত, কুঞ্চিত কেশদামে বাতাসের মৃদুস্পর্শ;
সম্মুখে রয়েছে সুসজ্জিত কাঠের পীঠিকা, সম্বৃদ্ধ লেখার সরঞ্জামে,
যুথীমাল্য ঘিরে আছে মসীধার, সুগন্ধী ধূপ জ্বলে কুলুঙ্গীতে,
তালপত্রে লিখে চলেছেন কিছু নিবিষ্ট আগ্রহে, বিদগ্ধ পুরুষ।

ক্ষণপরে থেমে যায় লেখনী,মুখ তুলে চান যুবা অন্যমনে,
দুচোখের ভাষায় অজ্ঞাত তৃষ্ণা, নীরব অভিব্যক্তি বেদনাবিধূর,
মধুময় দ্বিপ্রহরে, বসে থাকেন কবি, নিঃসঙ্গ মূরতি।
রামগিরি পর্বতে রাম-সীতার মিলন আশ্রমে, অভিশপ্ত যক্ষ,
কাটাবে দীর্ঘ বিরহকাল,
প্রণয় মাধুর্যের স্মৃতি নিষ্ঠুর দংশনে দংশাবে তিলে তিলে;
তাই কি মলিন কবির সুকুমার মুখ?
বিরহ কি শুধুই যক্ষের!
কৈলাস পর্বতে ফেলে আসা প্রেয়সী, সে কি শুধুই কল্পনা!

সিক্ত বাতাসের দমকে, শিহরণ জাগে, চোখ যায় বহির্পানে,
মধ্যাহ্নের প্রখর সূর্য উত্তাপহীন, যেন কোন জাদুমন্ত্রবলে;
উম্নুখ কেকারবে মুখর কানন।
মুগ্ধ বিস্ময়ে চেয়ে দেখেন কবি, কৃষ্ণমেঘ সবল প্রতাপে ঢেকেছে দিগন্ত,
প্রবল গর্জনে তার অগ্রীম বর্ষণ বার্তা;
দেশ দেশান্তরে বর্ষার ক্লান্তিহীন দূত, বয়ে নিয়ে যাবে আনন্দ সন্দেশ এমনই গৌরবে।
মৃদু হাসি ধরা দেয় ওষ্ঠাধরে, লেখনী সরব হয় তালপত্রে পুনর্বার,
“আষাঢ়স্য প্রথমদিবসে মেঘমাশ্লিষ্টসানুং
বপ্রক্রীড়াপরিণতগজপ্রেক্ষণীয়ং দদর্শ।।“
কবিশ্রেষ্ঠ নিমগ্ন হন কাব্যে তাঁর।

***
©2017 ananyapal ALL RIGHTS RESERVED

মঙ্গলবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

প্রণয়সাক্ষী


ভোরের নরম আলোয় অগস্ত্য তীর্থের নীল জল কাকচক্ষু,
গুহা অলিন্দে যক্ষ ও বক্ষলগ্না প্রেয়সী নবপ্রেমরসে বিভোর,
তোমার স্থাপত্য শিল্পে পেয়েছে প্রাণ রুক্ষ প্রস্তরখন্ড,
তোমার কল্পনায় আজ স্বর্গীয় যক্ষ প্রেমগাথা।

আমি দেবদাসী নিত্য আসা যাওয়া এই বিষ্ণু মন্দিরে,
অলক্ষে চেয়ে থেকেছি কতদিন, আত্মমগ্ন তুমি দেখনি ফিরে;
সেদিন বসন্ত পঞ্চমী তিথি, এমনি ভোরের আলোয় ঘুমিয়ে ছিলে গুহা মন্ডপে,
জাতি পুষ্পহার এসেছিলাম রেখে অতি চুপে  চরণে তোমার,
'দেবী উপাচারের মালাটি তোমার ভূমিতে লুটায়' -
পিছু ডেকে বলেছিলে।

'হায় শিল্পী, পাথরের বুকে নিত্য জাগাও যে প্রেম, সে কি শুধুই কল্পনা!
রূদ্ধ রেখেছ হৃদয়ের দ্বার, বসন্ত সমীর সেথা মাথা খুঁড়ে মরে' -
মৃদু তিরস্কারে বলে উঠি অভিমানে ।
'ভাল করে দেখেছ কি চেয়ে, যক্ষীণির মুখখানি অনঙ্গসেনা?
ও দুটি কালো আঁখি লাগে না কি চেনা, ওই ওষ্ঠাধর পদ্ম কোরকসম সেও কি অচেনা!'
মৃদু হাসি জেগে ওঠে তোমার ঠোঁটের কোণে,
আমি আত্মবিস্মৃত হই নতুন আবেগে,  জলে ভাসে আঁখি।

বহুযুগ পরে নব পরিচয়ে এসেছি আবার সেই পুরানো আলয়ে, 
প্রস্তরে প্রস্তরে সেথা বাজে প্রণয়ের সুর,
যক্ষী- যক্ষীণী আজো সাক্ষী হয়ে আছে আমাদের চিরমিলনের।।
***
©1917 ananyapal ALL RIGHTS RESERVED