বুধবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

দাদাগিরি

এমনিতেই আমার মাথাগরম বলে বদনাম, তার ওপর রীতিমত চর্চা করা তাগড়া চেহারা; লোকে আমায় বিশেষ ঘাঁটায় না । পাড়ার ভালো মন্দের দায়, ছেলে ছোকরাদের ওপর নজরদারি, সে একরকম আমি নিজের দায়িত্ব বলে মনে করি; তাতে মাঝে মধ্যে একে ওকে একটু কড়কাতে হলে কি বা এসে যায়! তবে আজ সকাল থেকেই বিলের কাণ্ড দেখে মেজাজ আমার সপ্তমে, এর একটা শেষ না দেখে আমি আর ছাড়ছি না । বেশ কিছুদিন ধরেই ঘোষ বাড়ীতে ওর চুপি চুপি যাতায়াত আমি লক্ষ করেছি, মিয়াঁ বিবি যখন কাজে যায় তখনই বেটা উঁকি ঝুঁকি মারে খিড়কির দরজা, নয় রান্নাঘরের জানলা দিয়ে । কার সায়ে এসব চলছে তাও বুঝি; গেলো মাসে ভালবেসে ও বাড়ির মিনিকে একটা ফিস ফ্রাই খাওয়াতে চেয়েছিলাম । তা দোকান থেকে বাগিয়ে আনতে একটু ঠাণ্ডা হয়ে গেছিল আরকি, অমনি মুখ ঝামটে বলল ‘বাসি খাবার আমি খাই না!’ আর এই ছিঁচকে বিলে, তার ওপর কি দরদ!

আজ তিতলিদির জন্মদিন, ঘোষ বাড়িতে হেভি খাওয়া দাওয়া, পাড়াশুদ্ধু লোকের নেমন্তন্ন; আমিও যাবো, তবে একেবারে শেষের দিকে, নেমন্তন্নের ধার আমি ধারি না । তাই তো বিলেটাকে সন্দেহ, আমি তো জানি ব্যাটা চুরি বিদ্যেয় এরই মধ্যে হাত পাকিয়েছে, নির্ঘাত লোকের ভিড়ে হাতসাফাইয়ের তালে আছে । আর চুরির দোসর যখন ঘরেই মজুত তখন আর পায় কে! কিন্তু আমি থাকতে সেটি হতে দিচ্ছিনা, তক্কে তক্কে আছি, আজ হাতে নাতে ধরে ওকে পাড়া ছাড়া করে তবে আমার শান্তি ।

বাড়ির ভেতর থেকে মাছের কালিয়া আর ভেটকির পাতুরির গন্ধে রাগটা প্রায় গলে যাবার জোগাড়, কিন্তু না, কর্তব্যে অবহেলা এ শর্মা করে না, তাই না পাড়ায় আমার এতো খাতির! যাইহোক, দিপুদের পাঁচিলের আড় থেকে আমি ঠিকই নজর রাখছি হতচ্ছাড়া বিলের ওপর । লোকজন বেশ কিছু আসতে শুরু করেছে, মিনি ঢঙ করে তিতলিদির সাথে সাথে ঘুরছে, যেন জন্মদিনটা আজ ওরই! খাওয়ার আসরে হাঁকডাক বাড়ছে, ঠাকুর সামাল দিতে নিজেই পরিবেশনে হাত লাগিয়েছে; এই মওকায় বিলে একলাফে বাড়ির ভেতর, আর যায় কোথায় আমিও মারলাম এক লাফ, একেবারে বিলের ঘাড়ে । দুজনে গড়াতে গড়াতে রান্নাঘরের দরজায়, গায়ের জোরে ব্যাটা নেহাত কম যায় না, সঙ্গে তেমনি গলার জোর, জাপটাজাপটি, গর্জন; আজ কেউ একপা পিছব না, যা থাকে কপালে । ‘আ মল যা, এদুটো আবার ঠিক জুটেছে! মাছের গন্ধ পেয়েছে কি হতচ্ছাড়াদের দৌরাত্ব শুরু । ফেলে দিয়ে আয় তো ন্যাপা দুটোর ঘেঁটি ধরে!’ ন্যাপার ঠাকুমার খোনা গলার চিৎকার কানে যেতে না যেতেই ‘ঝপাস!’ কে যেন খামচে নিয়ে চুবিয়ে দিলো ড্রেনের জলে । অপমানে চোখে জল এলো, এই দুনিয়ায় ভালো কারো করতে নেই । এতো যে নিঃস্বার্থে পাড়ার দেখাশুনো করি, নাহয় দু চারটে মাছের টুকরো তার বদলে খাজনা ভেবেই নিই, তাবোলে ছিঁচকে বিলে আর আমি এক হলাম!

এর থেকে তো মাছ খাওয়া ছেড়ে দেওয়াই ভালো.................. নাহ্ সেটা বোধহয় পারা যাবে না!



***

শুক্রবার, ৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

গরম ভাতে কাসুন্দি




অফিস টাইমের ভিড়, বাসটা মানুষের চাপে একদিকে হেলে পরেছে । দাদা একটু চাপুন তো!এক মুশকো জোয়ান হাঁকল মহিলা সিটের সামনে একপায়ে ভরে দিয়ে ঝুলে থাকা এক মিহি গোঁফকে । কি ব্যপার এবার কোলে বসবেন নাকি?’ জবরদস্ত মাসিমা ঝাঁঝিয়ে উঠলেন । দুদিকের হুড়োতে মিহি গোঁফ দিশেহারা, এরপর একেবারে ট্রাপিজের কায়দায় রড ধরে সিলিঙে ঝোলা যায় কিনা ভেবে দেখছেন । এই যে একটু সরে বসুন তো, বাচ্চাটাকে একটু বসতে দিন’; ‘কোথায় সরব আর জায়গা কোথায়?’ ‘কোনার সিটে অমন বেঁকে বসে আছেন আর জায়গা নেই! নিন সোজা হয়ে বসে বাচ্চাটাকে বসতে দিন। কথপোকথন চলছে বছর তিনেকের বাচ্চা কোলে এক অল্পবয়সী মা ও টিপটপ এক কলেজ পড়ুয়া আধুনিকার মধ্যে । আধুনিকা কথা না বাড়িয়ে সামান্য সোজা হয়, তাতে যে ইঞ্চি ছয়েক জায়গা হোল সেখানে বাচ্চা সমেত মা বসলেন বা বলা চলে বসার চেষ্টা চালালেন । ওরে বাবারে, হাঁটুটা একবারে থেঁতলে গেলো, ওইটুকু জায়গায় এতোবড় শরীর নিয়ে কেউ বসে!ফলতঃ এপাশের বউদির আর্তনাদ । এতবড় শরীর বলতে আপনি কি বোঝাচ্ছেন, আপনার শরীরই বা কম কিসে?’ ‘দেখুন, শরীরের খোঁটা দেবেন না, আমি আপনার খাই না পরি?’ ‘শুরু তো আপনিই করলেন!’ ‘একে জোর করে বসলেন তারওপর ঝগড়া করছেন লজ্জা করে না?’ ‘লজ্জা কেন করবে আপনি আমার শাশুড়ি নাকি?’ ‘ভাগ্যিস নই যা মুখ!’ চোপ, একেবারে চোপ! সকাল সকাল কোথায় একটু শান্তিতে যাব, তা না কাক চিল বসতে দেবে না!অল্পবয়সি মা আর বউদির যুগলবন্দীতে মাসিমার তারানা ।

অ্যাই, কি হচ্ছে সোজা হয়ে দাঁড়ান না, বাড়িতে মা বোন নেই নাকি?’ না কোনও দিদিমণি নয়, ঝাঁকড়া চুল কাঁধে ঝোলা বছর বাইশের এক দাদামনি সুর করে ধমকালেন মুশকোকে । যাচ্চলে, আপনি মা না বোন?’ মুশকোর ঠোঁটে নচ্ছারি হাসি । ছোটলোক!দাদামনি তাঁর অভিধানের সবচেয়ে চোখা গালিটি ঝাড়লেন, মুশকোর হাসি চওড়া হোল ।

দরজার কাছে ভিড় ঠেলে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন এক লম্বা বেনী দিদিমিনি, ‘একটু ভেতরে ঢুকতে দিন না’, দিদিমণির কাতর আহ্বান যেন রবি ঠাকুরের গান, মনে দোলা দেয় । আপাততঃ অবশ্য বাসটাই এমন দুলিয়ে দিলো যে লম্বাবেনী এক ছাপোষা দাদার একেবারে বুকে; আহা! যেন উত্তম সুচিত্রার এই পথ যদি না শেষ হয়’, অবশ্য ছাপোষা বউদি যদি দৃশ্যটা দেখতেন তাহলে পথের শেষ কোথায় গিয়ে হোত কে জানে! 

তখন থেকে বলছি সোজা হয়ে দাঁড়াতে, তবু হুঁশ নেই? আগে সোজা হয়ে দাঁড়ানো শিখে তবে বাসে উঠবেন, যতোঃসব !’  বাসের দুলুনিতে মিহি গোঁফও মাসিমার পদানত; এক্ষেত্রে অবশ্য প্রতিক্রিয়াটা প্রায় মহিষাসুর দলনী দুর্গার মত। দাদা টিকিট!ঠিক এইসময়ই কন্ডাক্টারের হাঁক মিহিগোঁফকে, ‘ব্যাপারটা কি বাস চালাতে পারেননা ঠিক করে আর টিকিট চাইতে এসেছেন?’ মাসিমার অপমানের ঝালটা পরল কন্ডাক্টারের ওপর । বাস ঠিকই চলছে, আপনার অসুবিধে হয় নেমে ট্যাক্সি করে যানসেও সমান তেরিয়া । কি বাস ঠিক করে চলছে? তখন থেকে ঢিকির ঢিকির যেন গরুর গাড়ী আবার ট্যাক্সি দেখানো?’ এবার সরব হলেন এক গম্ভীর চেহারার মেশোমশায়, আর তাঁর সাথে তাল জুড়ল প্রায় গোটা বাস । যা বলেছেন এই করেই কলকাতাটা একেবারে উচ্ছন্নে গেল । কথায় কথায় ভাড়া বাড়াবে অথচ কাজের বেলায় ফক্কা। বেগতিক দেখে কন্ডাক্টার সরে পরে, আলোচনা মোড় সম্পূর্ণ রাজনৈতিক । ‘এই যে কদিন পরপর ভার বাড়ানোর স্ট্রাইক এর পেছনে বিরোধীদের চক্রান্ত নেই ভেবেছেন?’ ‘আরে মশাই এ সবই সরকারের কারসাজি, ভোটের আগে ব্যাটাদের হাতে রাখতে চায়’। ‘মোটেই না কেন্দ্রীয় সরকার সব ব্যাপারে হাত উলটে বসে আছে তো রাজ্য সরকারের কি দোষ?’ ‘দেখুন মশাই সব কথায় কেন্দ্রকে টেনে আনবেন না, যতো বাহানাবাজ!’ ‘দেখুন মুখ সামলে, কেন্দ্রের নামে বললে আপনার গায়েই বা লাগছে কেন?’ ‘আপনি মুখ সামলে!’

ডালহৌসি, ডালহৌসি!কন্ডাক্টারের চিল চিৎকার যেন যুদ্ধবিরতির ঘোষণা; মৌচাকে ঢিল পরার মতই লেগে যায় হুড়োহুড়ি, লক্ষ্য একটাই, তাড়াতাড়ি বাস থেকে নামা । 

***