সোমবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

লুটের বাতাসা

মেয়ের বিদেশী স্কুলে কমিউনিটি সার্ভিস তথা নানা সমাজসেবামূলক কাজকর্ম হয়ে থাকে, সেসব কাজের জন্য অর্থের যোগাড়ও হয়ে থাকে বিভিন্ন উপায়ে; যথা নানান অনুষ্ঠান (ডান্স পার্টি, থিয়েটার ইত্যাদি), সর্বোপরিসেলএ জামাকাপড় বিক্রি থেকে এইসেলব্যপারটা ভারি জনপ্রিয় এবং প্রতিবারই নির্ধারিত দিনে অভিভাবকেরা যেরকম মরীয়া হয়ে সমাজসেবায় ছুটে আসেন, তা সত্যিই হৃদয়স্পর্শী

আমরা তখন ঢাকায় সদ্য এসেছি, স্কুলে নতুন; খবর পেলাম এরকম একটি সেলের। মেয়ের সহপাঠিনীর মা, ভারী উপকারী, নিজে থেকেই উৎসাহ দিলেন, ‘দুশো টাকা রেটে ঢালাও প্যান্ট, জামা, ড্রেস, এমনকি গরম জামা পর্যন্ত; সব ভালো ভালো ব্রান্ডের’ আমাকে এর বেশী বলার প্রয়োজন হোলনা, সমাজসেবার মহৎ উদ্দেশ্যে ততক্ষণে আমি অদম্য যাইহোক, নির্দিষ্ট দিনে সময়ের বেশ কিছু আগেই বেরিয়ে পরলাম নিমরাজি মেয়েকে বগল দাবা করে; ওকে সঙ্গে নেবার মুল উদ্দেশ্য ভীড়ের মাঝে বোঁচকা সামলানো, মুখে অবশ্য বললাম, ‘নিজে পছন্দ করে নিতে পারবে, ভালো হবে না?’ পৌঁছে দেখি হলের বন্ধ দরজার সামনে কাতারে কাতারে জন সমাবেশ; আকৃতি, প্রকৃতি, বর্ণ, জাতির বৈচিত্রে মিল শুধু একটাই, হাতে সকলেরই বড় বড় ঝোলা। বুঝলাম, এ বড় শক্ত ঠাঁই; ‘চোখ, কান খোলা রেখো’ মেয়েকে সতর্ক করে রেসের ঘোড়ার মত তেরিয়ে রইলাম দরজা খোলার অপেক্ষায়। এভাবে কাটল বেশ খানিক্ষন, স্বাভাবিক নিয়মেই একটু আলগা হয়েছে আমার তৎপরতা; অমনি আচমকা খুলে গেলো গুপ্তধনের গুহা। কিছু বোঝার আগেই প্রায় ভাসতে ভাসতে ঢুকে পড়লাম ভেতরে, ভাগ্যিস মেয়ের হাতটা ধরা ছিল তাই নিরুদ্দেশ ঘোষণার প্রয়োজন হোল না। তবে মুশকিল অন্য দিকে, ঢুকে তো পড়লাম, কিন্তু থামা দায়। এ টেবিল, ও টেবিল পেরিয়ে স্রোতে ভাসতে ভাসতে উপায় না দেখে শেষে একখানা টেবিল ক্লথ প্রানপনে খামচে ধরলাম। যাক, এবার থামা গেছে ভেবে সুস্থির হবার আগেই, ‘এক্সকিউস মি’ তীক্ষ্ণ হুংকারে চমকে দেখি, টেবিল ক্লথ নয়, আমি এক শ্বেতাঙ্গিনীর সাদা ফ্রকের কোনা চেপে ধরে আছি। কোনমতে ক্ষমা চেয়ে তেড়ে গেলাম সামনের টেবিলে ঢাঁই করে রাখা টিশার্টের দিকে।একটা বেগুনী টপ চোখে লাগল, হাত বাড়াতেই একটা থাবা নাকের ওপর দিয়ে সেটা উড়িয়ে নিয়ে গেলো; এরপরে লাল, সবুজ, কমলা তাক করেও কোনটাই কব্জা করতে পারছি না। এবার একটা লেসের কলার ওয়ালা নীলচে টিশার্ট নজরে আসতেই প্রানপনে চেপে ধরলাম, টানবার আগেই এক ছ-ফুটিয়া লালমুখো তার আর এক দিক চেপে ধরল। সেও ছাড়বে না, আমিও হয় এসপার নয় ওসপার; খানিক চলল এই টাগ অফ ওয়ার, শেষে আমার গোঁ দেখে সাহেব রণেভঙ্গ দিলো, জয়ের উল্লাসে আত্মহারা আমি খেয়াল করলাম না টানাটানিতে সাধের কলার ভীতু কুকুরের কানের মত ছেতরে গেছে। এভাবে যুদ্ধনীতি খানিক রপ্ত হতে ঠিক করলাম বাছাবাছি পরে, আগে যা পাই ওঠাতে হবে; এ ব্যাপারে দেখলাম মেয়ে আমার থেকে চৌকশ, মিনিট দশেকের মধ্যেই খান কুড়ি জামা কাপড় বাগিয়ে ফেলল। যা হোক বাছাবাছির সুযোগ নেই, তাই মোটামুটি আন্দাজে সাইজ দেখে নিয়ে কাপড়ের বান্ডিল জড়ো করে এগোলাম কাউন্টারের দিকে। ভল্যান্টিয়ার হিসেব কষছেন, তাতেও শান্তি নেই; এক ক্ষীণতটি পীতাঙ্গীনি (সম্ভবতঃ টেবিলে টেবিলে বিশেষ সুবিধে করতে না পেরে) ফিরতি পথে আমার সংগ্রহে হাত বাড়িয়েছেন। ‘এক্সকিউস মি’ এবারে আমি হুংকার দিলাম অনেকটা ‘সিংহাম’ স্টাইলে।    

ব্যাগ বোঝাই ও পকেট হালকা করে বাড়ি ফিরে সদর্পে পসরা খুলে বসলাম; উদ্দেশ্য আমার বিচারবুদ্ধির ওপর সম্পূর্ণ আস্থাহীন বাড়ির কর্তাটিকে তাক লাগিয়ে দেওয়া। প্রথমেই দুটো টপ বেরোল, একটা মেয়ের বছর দুয়েক আগেকার সাইজ, অন্যটাতে মা মেয়ে দুজনে একসাথে ঢুকে যাওয়া যাবে। এ ভাবে কোনটার বিটকেল আকৃতি, কোনটার বা উৎকট রঙ মোটের ওপর আমার মত অতি উৎসাহীর ও কাছাখোলা অবস্থা। ‘হরির লুটের বাতাসা, মন্দ কি!’ কথাটা হাওয়ায় উড়িয়ে আমার স্বল্পভাসী পতিদেব ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন; যেতে যেতে যে খিঁকখিঁকে হাসিটা উপহার দিয়ে গেলেন, মনে হোল একশটা ডেঁয়ো পিঁপড়ে একসাথে কামড়ে দিলো।   
  

***

শনিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

উত্তর মেলেনি

প্রায় দুযুগ আগের কথা, হয়নি বেশিদিন বিয়ের;
ব্যস্ততার জীবনে হঠাৎ পাওয়া ছুটিতে দুজনেই উচ্ছ্বল -
ঠিক হোল যাব দীঘা, বাঙালীর আটপৌরে গন্তব্যস্থল।

দূরপাল্লার বাসে দিলাম পাড়ি,
হালকা শীতের আমেজে আসন্ন উৎসবের আভাস,
বয়সটাও ভালো লাগার;
ছুটির দুটো দিন পাখনা মেলে উড়ে গেল স্বপ্নের ঘোরে।

ফেরার দিন একটা সুখস্মৃতি, কিছুটা বিষন্নতা আর একরাশ ঝিনুকের গয়না ব্যাগবন্দী করে হাজির হলাম বাসস্ট্যান্ডে।
ছুটিফেরতা যাত্রিদের ভীড়ে জায়গাটা সরগরম,
টিকিট পেলাম বটে, তবে প্রায় পেছনের সীটে।
পছন্দের জানলার ধারে বসে, শেষবার দেখে নিচ্ছি বাইরেটা -
বাস ছাড়বার মুখে।

হঠাৎ একটা হৈচৈ, কিছু বোঝার আগেই বাসে উঠে পড়ল এক যুবতীসহ জনা চারেক যুবকের একটা ছোট দল।
শেষ মূহুর্ত্তের টিকিট, কন্ডাক্টর দেখিয়ে দেয় ইঞ্জিনের পাশের চিলতে বেঞ্চ -
বাস কর্মচারীর নির্ধারিত সীট, যা ভীড়ের দিনে যাত্রীদের শেষ ভরসা।
'এয়ার্কি আরকি, আমি বসবো এখানে?' মহিলার স্বরে অমার্জিত ঔদ্ধত্ব,
'আপনি লাস্ট সীটে চলুন, হয়ে যাবে যা হোক করে,
গোবেচারা কন্ডাক্টর আপোশ-উন্মুখ।

'আমি একা বসবো! এরা কি মাগনা উঠেছে বাসে?'
যুবতীর তিরষ্কার জাগিয়ে দেয় সঙ্গীদের পুরুষাকার অচিরেই;
ফলস্বরূপ সীটচ্যুত হয় শেষের সারির কয়েকজন,
এক বৃদ্ধ অসম্মতি জানিয়ে খান গলা ধাক্কা -
বাদ যায় না কন্ডাক্টার ও, সপাট চড় নেমে আসে তার গালে, বৃদ্ধের হেনস্থার প্রতিবাদের জেরে।
বাকী যাত্রীরা সমাহিত হয় নির্বেদ স্তব্ধতায়,
হয়ত ছাপোশা বাঙালীর এ এক অসহায় আত্মনির্যাতন।

বাস চলতে শুরু করে, তার সাথেই শুরু হয় পেছনের সীটে নির্লজ্জ প্রমদ-উল্লাস;
মক্ষীরানিকে ঘিরে চার যুবকের অমার্জিত কথাবার্তায় শিউরে উঠি,
মননিবেশ করি পথসঙ্গী হাতের বইটিতে।

কোলকাতা আসতে আর নেই বেশী দেরী, বাস থামল একটি পেট্রল পাম্পে;
ট্যাঙ্কে ইন্ধনপূর্তী, সাথে ক্ষনিক জলপানের বিরতি।
সকলেই প্রায় নেমেছে বাস থেকে, জল না হোক খোলা বাতাসই বা কম কি?
নেমেছে যুবতীর তিনসঙ্গী,
থেকে গেছে একজন, বুঝিবা একাকী সঙ্গলোভে।

আলগোছে জানলায় হাতরেখে চোখ রাখি সিঁদূরী আকাশে,
অস্তরাগের আভায় ছলকে ওঠে আমার তরুণ মন।
আচমকা কাঁচের পাল্লাটা ঝাঁপিয়ে পড়ে হাতের আঙুলে,
প্রচন্ড ব্যাথায় সরিয়ে আনি হাত,
চোখে জল আসে তীব্র আঘাতে।
'জানলাটা বন্ধ করলি কেন?' যুবক ধমকে ওঠে ক্ষনপূর্বের প্রণয়িনীকে,
তার কর্কশতায় থমকে যায় উদ্ধত যুবতী।

'খুব লেগেছে আপনার? একটু জল দেবেন হাতে?' প্রশ্নটা আমাকে,
যুবকের প্রশ্নে স্পষ্ট উদ্বেগ, কোমল ব্যঞ্জনায় আফসোসের ছোঁয়া
বিস্ময়ে বাক্যহারা আমি মাথা নেড়ে অসম্মতি জানাই।
বাকি রাস্তা মেয়েটি নিশ্চুপ,
আমার মনেও বিস্মিত জিজ্ঞাসা।

এরপর কেটে গেছে বহূকাল,
জীবনের পরোতে পরোতে জমেছে অভিজ্ঞতার পলি;
তবু সেদিনের অসঙ্গতির  আজ ও উত্তর মেলেনি।

***

সোমবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

প্রতীক্ষা

ছোট্ট বুক রোমাঞ্চে দুরুদুরু,
গ্রীলের ফাঁক দিয়ে চেয়ে আছে দুটি সরল চোখ অসীম আশায়;
পুজোর আর কটা দিন বাকি -
অফিস ফেরতা পথে বাবা আনবেন পুজোবার্ষিকী।

গরমের ছুটির নির্জন দুপুরে,
দরজায় কান পেতে থাকা পিওন কাকুর অপেক্ষায়,
আসবে কি আজ চিঠি প্রিয় বান্ধবীর -
কিশোরী মনের উচ্ছাস  যার পাতায় পাতায়?

ফোনের আওয়াজ কানে যেতেই পাদুটো বশে থাকেনা আর,
দৌড়ে গিয়ে রিসিভার তুলে 'হ্যালো'?
এটা মেজমাসী, ফোনটা মায়ের;
পরেরটা ঘোষ কাকু, দরকার বাবার সাথে,
আসে পড়ুয়া বন্ধুর ফোন, অথবা নেহাৎ গল্প বিলাসী।
আশা নিরাশার দোলচালে তবু চলে অনন্ত প্রতীক্ষা,
আজো কি যাবে না শোনা সেই চেনা ডাক - পরবাসীর?


শ্রাবণ ঘন সন্ধ্যা, বাইরে মনকেমন করা চাপচাপ অন্ধকার;
মনের উচ্ছ্বাস তবু বাঁধ মানেনা আর,
বহুদিন পরে আসছে মেয়েটা,
গাড়ীর আওয়াজ হলো কি - এত দেরী কেন?
সময়ের হিসেব হারায় আমার মাতৃহৃদয়ের অধীরতা।


রাত্রি নিশুত, বিছানার পাশে বসে আয়া মেয়েটি ঢুলছে,
আজ কি পূর্ণিমা? রূপোলি জোছনা, জানলার পর্দাকে ফাঁকি দিয়ে আলতো ছুঁয়ে আছে আমায়;
কি শান্তি! এখনো কি হয়নি সময়?
আমি যে পথচেয়ে আছি প্রিয়তম -
চিরমিলনের আশে এ আমার শেষ  প্রতীক্ষা।


@ananyapal2015