রবিবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১৮

দাঁড়ে দাঁড়ে দুম্!

ভিয়েতনাম বেড়াতে এসেছি আমরা কর্তা গিন্নি; আমার উদ্দেশ্য চম্পার ধ্বংসাবশেষ দেখতে যাওয়া, কর্তা চান ছুটিতে কদিন গা এলাতে, তাই সেই সাথে হ্যালং বে তে দুরাত্রির নৌযাত্রা প্রমোদ তরণীতে। নৌযাত্রায় নানান বিনোদন, তার মধ্যে একটি হোল কায়াকিং অর্থাৎ ছোট ছোট নৌকায় নিজে নিজে দাঁড় টেনে নৌকাবিহার।

সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট সেরে জাহাজের গাধা বোটে করে আমাদের নিয়ে যাওয়া হোল আলাদা একটি জায়গায়, যেখানে মাঝ সমুদ্রেই পাটাতন বানিয়ে গুচ্ছের প্লাস্টিকের হালকা নৌকা সাজিয়ে তৈরি হয়েছে কায়াকিং সেন্টার. যাওয়ার আগে বলা হয়েছিল সাথে আর এক সেট কাপড় নিতে; 'শান্তিমত দাঁড় টানলে জল ছিটবে না, তুমি দয়া করে নাচানাচি কোর না' কর্তার কথায় আস্বস্ত হলাম. বিয়ের পরে যদিও দেখিনি কখনো তবে মনে হোল উনি এব্যাপারে অভিজ্ঞ, আমার অবশ্য এটাই প্রথমবার।

যাইহোক, লাইন দিয়ে দাঁড় সংগ্রহ করলাম, কর্তা পছন্দ করে দুটো ম্যাচিং নীল রঙের দাঁড় নিলেন, দেখলাম এগুলো খুব হালকা আ্যলুমিনিয়ামের রড দিয়ে তৈরি, চালানো সহজ হবে, অতএব আমার উৎসাহ ততক্ষনে তুঙ্গে। একেকটি নৌকায় দুজন করে যাবে, সামনে পেছনে করে বসতে হবে। আমাদের পালা আসতে ব্যাবস্থাপক লোকটি জানতে চাইল, 'তোমাদের মধ্যে বেশী ভাল কে জানে? সে পেছনে বসবে'; অবশ্যই আমার পতিদেব পেছনে বসলেন, আর আমি সামনে। আমাদের আগে যারাই নৌকায় চড়েছে, দেখছিলাম প্রথম থেকেই কোন দিকে যাবে সেই হিসেবে দাঁড় টানতে শুরু করছে। আমরা একটু ফাঁকায় যাবো, চল বাঁ দিকটায় যাই', নৌকায় বসেই নির্দেশ পেলাম, সাথে সাথেই বাধ্য সৈনিকের মত প্রবল উৎসাহে দুহাত দিয়ে জলের মধ্যে মাছের ফাতনা নাড়ার স্টাইলে দাঁড় টানতে শুরু করলাম। পেছন থেকে ঠেলে দেওয়ায় নৌকাটা যেটুকু এগিয়েছিল, হঠাৎ দেখি লাট খেয়ে সেখান থেকে আবার পাটাতনের দিকেই তেড়ে যাচ্ছে, আমার শত দাঁড় ঝাপটানিতেও কোনো কাজ হচ্ছে না। ঠিক সেই মূহুর্তে এক বৃদ্ধ ব্রিটিশ দম্পতি নৌকায় বসছিলেন, আমাদের নৌকা গিয়ে গুঁতিয়ে দিলো তাদের নৌকাটাকে, ফলস্বরূপ প্রচন্ড ঘাবড়ে ভদ্রলোকের হাত থেকে ছিটকে পড়ল দাঁড়; প্রাণভয়ে আমাদের নৌকটাকে প্রবলভাবে ঠেলে দিলেন উনি। আর তাতেই বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়ে জলের স্রোতে পড়া গেল। 'তোমার আনতাবড়ি দাঁড় টানাতেই এমন হোল' খেঁকিয়ে উঠলেন পতিদেব। 'আরে তিনশ বছর ধরে ওরা আমাদের গুঁতিয়েছে, আর এখন এমন দুএকটা ছোটখাটো গুঁতো মারা তো আমাদের জন্মসিদ্ধ অধিকার, ওতে দোষ হয়নি' আমি সান্ত্বনা দিলাম।

জলের স্রোতে তো পড়া গেল, কিন্তু প্রাণপন দাঁড় টেনেও দেখি আমাদের নৌকা আর নড়ে না। বাকিদের তরতর করে এগিয়ে যেতে দেখে, 'জোরে দাঁড় টানো না' আমিচেঁচিয়ে উঠি। 'তুমি চুপ করে বসলেই এগোনো যাবে নির্দেশ এলো। আসলে আমরা দুজন দুদিকে দাঁড় চালানতেই ওই গোলমাল; এদিকে জল ছিটে এরিমধ্যে আমার জামাকাপড় একশা, বাধ্য হয়ে আমি ক্ষান্ত দিলাম। এরপর দেখি নৌকটা ডানদিকে চলেছে, 'বাঁদিকে যাবো বলছিলে না?', 'এদিকটাও চলবে জবাব এলো, বুঝলাম ভাল নাবিকের হাতেই পড়েছি। এভাবেই চলছিলাম বেশ, হঠাৎ আর একটা বোট সামনে এসে পড়ল, বা বলা যায় আমরাই ওদের সামনে গিয়ে পড়লাম। ওরা পাশ কাটাতে চেষ্টা করছে, এদিকে আমাদের বোট ক্যাপ্টেনের যাবতীয় কাপ্তেনি ব্যার্থ করে ওদের দিকেই ধেয়ে গেল। আমি ভ্যাবাচাকা খেয়ে চক্রব্যূহে রথের চাকা হাতে অভিমন্যুর স্টাইলে আমার হাতের দাঁড়টাকে শূণ্যে ঘোরাতে শুরু করেছি, ওদিকের নৌকোয় সামনে বসা পুতুল পুতুল চেহারার চৈনিক তরুণীর চিলচিৎকারে শান্ত পরিবেশ উত্তাল। ধাক্কা আটকানো গেলনা, তরুনীর পেছনে বসা চেংগিস খাঁয়ের রক্তচক্ষু আমার রক্ত হিম করে দিল। 'বলি করছ টা কি?' বিরক্ত হয়ে পেছন ফিরে দেখি বাঁ কাঁধ চেপে ধরে বসে আছেন ক্যাপ্টেন. 'তোমার দাঁড়ের বারি খেয়ে আমি কি কিছু করার অবস্থায় আছি?' জবাব এল। এসব গন্ডগোলে উপকার হল এই যে আশেপাশের বোটগুলো আমাদের থেকে দূরে যেদিকে পারল ছিটকে গেল, ফলে আমরা একেবারে নির্জন পরিবেশে ভেসে বেড়াতে লাগলাম।

সময় শেষ হয়ে আসছে, এবার ফেরার পালা; কিন্তু ফিরব কি করে জানা নেই। 'এখানেই চুপ করে এঁটে থাকি, ওরা নিজেরাই ঘেঁটি ধরে নিয়ে যাবে তাহলে' আমি পরামর্শ দেবার চেষ্টা করি। 'তোমাকে নিয়ে বেরোলেই যত অনর্থ' কর্তা খেঁকিয়ে উঠে আত্মসম্মান রক্ষা করলেন। এতক্ষনে আমাদের গাইড হাত নেড়ে আমাদের ফিরতে বলছে দূর থেকে। আমি দেখলাম ক্যাপ্টেনের কম্ম নয় আমাকেই করতে হবে কিছু। আমিও হাত নেড়ে বোঝাতে চাইলাম ফিরতে পারছি না। মেয়েটি অবস্থা কতক আন্দাজ করে কোন দিকে দাঁড় বাইতে হবে হাত নেড়ে দেখাতে শুরু করল, এবার কর্তাকে হাঁকিয়ে আমিই দায়িত্ব নিলাম দাঁড় টানার। মেয়েটির ইশারা লক্ষ্য করে হাঁচোড় পাঁচোড় করে ফাতনা নেড়ে পাটাতনের কাছাকাছি পৌঁছতে, ব্যাবস্থাপক বোটের দড়ি ধরে টেনে বাকিটা সামলে নিল। পতিদেব গম্ভীর মুখে আগে নামলেন, নামলাম আমিও, তবে নামতে গিয়ে হাতের দাঁড় গিয়ে ঝাপটা মারল ব্যাবস্থাপকের পশ্চাতে।

আমাদের নৌকাবিহার চিত্তাকর্ষক না হলেও বেশ লোমহর্ষক হয়েছিল (আমাদের নয়, অন্যদের জন্যে) একথা মানতেই হবে; এরপর বাকি বেলা দুজনের মধ্যে কথা বন্ধ ছিল বলাই বাহুল্য।

***
©1918 ananyapal ALL RIGHTS RESERVED