শনিবার, ২১ নভেম্বর, ২০১৫

আত্ম বিপণন

শীতের মরসুমে একতলার ফ্ল্যাটের চিলতে বাগানে,
ফুটেছে একটিমাত্র হলদে গোলাপ,
অনেক যত্নে আদরে বেড়ে ওঠা আমার ছাপোষা জীবনের সুখবিলাস;
হালকা ভোরের হাওয়ায় তার দুলে ওঠা,
পড়ন্ত বিকেলের মেটে আলোয় পাঁপড়ির ভাঁজে ভাঁজে জেগে থাকা স্বর্ণাভা,
ছড়িয়ে দেয় এক সুখানুভুতি আমার মনে,
গোপন গর্বে নিজেকে বিশিঢ্ট মনে হয় -
সে আমার, একান্ত আমার, ঈষৎ নুয়ে পড়া ভঙ্গীতে সম্মতি জানায় সে নিজেও।


সেদিন বিকেলে হঠাৎ ই মালিনী এলো আমার এক কামরার ফ্ল্যাটে,
আসার আগে শুধু ছোট্ট একটা মেসেজ, 'আসছি' -
মালিনী অমনই, রূপকথার পরীর মত কখনো সখনো
কয়েক লহমার সৌরভে ভাসিয়ে দিয়ে আবার হারিয়ে যায় পলকেই,
স্বপ্নময় সেই কটি মুহূর্ত জমা হয় আমার মণিকোঠায়।

শীতের আমেজভরা হিমেলী বিকেলে আমার দরজায় মালিনী,
পরণের কাঁচাহলুদ শাড়ীতে আগুনের আভা শরীরের প্রতিটি ভাঁজে,
কোঁকড়া চুলের আলগোছা খোঁপা নিপুণ অন্যমনষ্কতায়
হেলে আছে ঘাড়ের কাছে, সুন্দর মুখখানি প্রসাধনে অপরুপ;
আমি মুগ্ধ বিস্ময়ে বাকরূদ্ধ।


'এলাম দরকারে' -
জড়িয়ে পরেছে কোন বিশ্রী পুলিস কেসে, অসংযমী জীবনযাত্রায়,
আমার সাংবাদিক জীবনের যোজসাজশ কাজে লাগাতে হবে,
এটাই দরকার।
তার অভিমাণী স্বর আর মোহিনী ভঙ্গিমায়,
স্বার্থপর সাহায্যের অভিলাষ অলৌকিক মনে হয় আমার কাছে,
নিঃশর্তে নিজেকে বিকিয়ে দিতে আমি তৎপর।

কথা শেষ হয়, চলে যেতে যেতে দরজার কাছে আবার ঘুরে দাঁড়ায় মালিনী,
'গোলাপটি তো বেশ? ঠিক আমার শাড়ীর রং না?'
মিষ্টি হেসে এগিয়ে যায় সে আমার চিলতে বাগানে,
আমি অভিভূত, বাগান করা স্বার্থক মনে হয় এতদিনে।
'দেবে না আমার খোঁপায় পরিয়ে?' মালিনীর ভ্রূভঙ্গিতে আমি আত্মহারা,
ছুটে গিয়ে বৃন্তচ্যুত করি আমার দিবারাত্রের সঙ্গিনীকে,
মালিনীর খোঁপায় অভিমানে মুখ লোকায় কাঞ্চনবরণী।
গর্বিত পদক্ষেপে চলে যায় স্বপ্নের মেয়ে,
আমি বসে থাকি একা আধো অন্ধকারে আমার বাগানে;
ফুলহীন কাঁটা ঝাড় সাক্ষী হয়ে থাকে আমার বিশ্বাসঘাতকতার।
***


মঙ্গলবার, ১০ নভেম্বর, ২০১৫

কালরাত্রি

রোগাটে ছোটখাট চেহারা, গায়ের রঙটা রোদে-জলে তামাটে,
ভীতু ভীতু মুখখানি থেকে অনাহার কেড়ে নিতে পারেনি লাবন্য এখনো;
বছর দুয়েকের শিশুটিকে নিয়ে ব্যস্ত রাস্তার ফুটপাতে তার আস্তানা।
দিনভর ছেলে কোলে ভিক্ষে, কখনও বা কাঙালি ভোজন,
একটা পুঁটুলিতে গোছানো সংসার; ছেঁড়া কাঁথা, জলের গেলাস, গোটা দুই শাড়ী।
রাতের বিশ্রাম ওই ফুটপাতেই,
যেখানে সারি সারি ক্লান্ত শরীরের ভীড়ে একটা জায়গা আছে তারও;
ঝিমধরা  সাঁঝবাতির কোণ ঘেঁষে ছেঁড়া কাঁথার ছোট্ট বিছানায়।
মেয়েটা একা, তবে নিঃসঙ্গ নয়; নামহীন পুরুষসঙ্গী জোটে মাঝে সাঝে,
পেট বড় দায়;
ফুটপাতের ঘুমন্ত রাজ্য মহাস্থবির – সমাজ বহির্ভূত আরেক সমাজ,
প্রবৃত্তির নিবৃত্তি সেখানে অপরাধ নয়।

কালীপূজোর রাত, আলোকমালায় ঝলমলে শহর, তারাবাজির আলপনায় আকাশ দীপান্বিতা;
আলো আঁধারির ফুটপাতে শুয়ে আছে একদল ছায়া, বিশ্রামই তাদের একমাত্র বিলাস।
শুয়ে আছে মেয়েটাও, শরীর তার বিবশ আজ ক্লান্তিতে;
জাঁকজমকের বারোয়ারি পূজোর বস্ত্রদানের আয়োজন,
দুপুরে পৌঁছেছিল সেখানে ছেলে কোলে, একখানা কম্বলের  আশায়।
গিয়ে দেখে অসংখ্য মানুষের ঢল, 
বাঁধ ভাঙা কাঙালির ভিড়ে মরীয়া মেয়েটা প্রাণপণে ছুটেছিল দানের মঞ্চে,
ঠেলাঠেলি, প্রতিদ্বন্দ্বী ভিখারীর অশ্রাব্য চিৎকার, ছেলেটার ভয়ার্ত ক্রন্দন,
ছুঁতে পারেনি কোনও কিছুই, আসন্ন শীতে কম্বলের ওম বড় মোহময়।  
জনতার উন্মত্ত ভীড়ে বেসামাল আয়োজন, বন্ধ হয় দানসভা,
কয়েকঘন্টার পাশবিক লড়াই, প্রাপ্তির মধ্যে পুলিশের লাঠির কয়েক ঘা,
কোনক্রমে ফেরে আস্তনায়, উৎসবদিনের অভুক্ত কাঙালিনী।

ছেলেটা কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পরেছে কিছু আগে,
ক্লান্তির নিদ্রা ভিড় করে আসে তারও চোখে;
‘আসবি একবার ওদিকে?’ নেশা জড়ানো স্বরের মৃদু আহবানে সচকিত হয় মেয়েটা।
গলির মোড়ে বহুতল বাড়ির রাতের দ্বাররক্ষী,
স্বজনহীন শহরে মাঝে সাঝের সঙ্গী, উৎসব রাতে তার মনেও রোমাঞ্চ;
‘আজ ছেড়ে দাও বাবু, শরীলটা ভালো নেই’।
‘চল না পয়সা পাবি তো’, প্রথমে অর্থের লোভ, তারপর মিনতি,
নারীসঙ্গের লোভে বাবুটিও আজ মরীয়া, ভিখিরি মেয়েটার অসম্মতি অসহ্য তার কাছে
‘কি রে কানে যাচ্ছে না কথা, কিসের গুমোর এতো?’ চাপা আক্রোশে গজরায় লোকটা,
‘বলেছি তো আজ নয়; ছেলেটাকে ঘুম পাড়িয়েছি বহুকষ্টে, যাও তুমি’,
‘ছেলে? আজ আছড়ে মারব তোর ছেলে!’ ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মত তেড়ে আসে প্রবৃত্তির দাস।
নিমেষে বদলে যায় প্রেক্ষাপট,
‘ছুঁয়ে দেখো খোকাকে আমার!’ থান ইট হাতে রুখে ওঠে শান্ত মেয়েটা,
উন্মত্ত চোখের দৃষ্টি, শাড়ির আঁচল আলুথালু, রুখু খোলাচুলে সে আজ ভীষণা;
পিছুহটে বলিষ্ঠ দানব, ঔদ্ধত্ত নয় চোখেমুখে শুধুই আতঙ্ক।
উৎসবরাত্রি পূর্ণ হয় অবশেষে,
অমানিশার ঘোর অন্ধকারে, জেগে ওঠেন দানবদলনী দেবী মহা কালরাত্রি।


***