বৃহস্পতিবার, ২৯ অক্টোবর, ২০১৫

তুলসী বিবাহ

পূব আকাশের ধুসর চাঁদোয়ায় সবে লেগেছে ফাগুনের আবির,
পাতালরাজ্য সুষুপ্তির অন্ধকারে;
দীপের আলোয় জেগে উঠেছে শুধু একটি কক্ষ।
পাতালপুরীর রাজদেবালয়ে পূজোয় বসেছেন রানী বৃন্দা,
সম্মুখে শ্রীবিষ্ণুর স্বর্ণমূর্তি স্মিত আলোয় উদ্ভাসিত।
পরনে পবিত্র কাষায় বস্ত্র, অঙ্গে অলঙ্কার সামান্যই;
কপালে অলকা তিলক,রাজেন্দ্রাণীর সমাহিত রূপ শ্রদ্ধা জাগায়।
লঙ্কাপতির মামাতো ভগ্নি, কালনেমি পুত্রী, পাতালরাজ জলন্ধর মহিষী,
তবু বিষ্ণুসেবিকা এই পরিচয়েই তিনি ধন্যা।
ভক্তিতে একনিষ্ঠ, সতীত্বে উজ্জ্বল নারীশ্রেষ্ঠা সুন্দরী বৃন্দা –
রাক্ষসকুলে জন্মেও নারায়ণ কৃপাধন্যা;
পত্নীর সতীত্ব তেজে বলীয়ান অনার্য জলন্ধর ত্রিভুবনে অপরাজেয়।

পাতাল নৃপতি জলন্ধর মানতে চায়না আর্যকুলের শ্রেষ্ঠত্ব,
জন্মসূত্রে নয়, পুরুষাকারেই অর্জিত যে তাঁর সার্বভৌমত্ব;
অনার্য রাজার স্পর্ধায় বিস্মিত ইন্দ্র, সুরাসুর যুদ্ধ দেখা দেয় অনিবার্যরূপে।
যুদ্ধ অসম, তবু জয়ী হয় বীর জলন্ধর, নিজ বাহুবলে;
পরাজিত, ভীত, দেবকুল আশ্রয়প্রার্থী কৈলাসধামে, মহাদেব ভরসা তাঁদের।
যুদ্ধ শুরু হয় অসম্ভবের, দিবারাত্রি রনডঙ্কায় দশদিক প্রকম্পিত;
অটল নিজ বিশ্বাসে বৃন্দা সুন্দরী শুধু অবিচলিত –
বিষ্ণু আশীসে সে যে চিরায়ুষ্মতী।

উজ্জ্বল মশাল জ্বলে চতুষ্কোনে, দীপদন্ডে সহস্র মঙ্গলদীপ,
রাত্রি মধ্যযাম গত, তবু সুরলিত বিষ্ণুমন্ত্রে মুখরিত পুজাগৃহ;
অখন্ড উপাসনারত সতী বৃন্দা, বিজয়ী স্বামীর আগমনেই করবে আসন ত্যাগ।
‘প্রিয়ে’ অতিপরিচিত স্নেহ সম্বোধনে চোখ মেলে রানী, স্মিত হাসি জাগে ওষ্ঠাধরে,
সম্মুখে বিজয়ী জলন্ধর দুবাহু বাড়িয়ে, দীর্ঘ বিচ্ছেদ শেষে চোখদুটি মিলনে উন্মুখ।
প্রিয় বাহুপাশে কয়েক মুহূর্ত অনন্তকাল সম, ওষ্ঠাধর পুলকিত গভীর চুম্বনে,
আসঙ্গসুখে মুদে আসে আঁখি, অনুরাগে রাঙা মুখ প্রস্ফুট গোলাপ,
‘তুমি সুখী প্রিয়ে?’ গভীর প্রণয়ে চোখ মেলে চায় বৃন্দা স্বামী মুখপানে।
আচমকা গর্জায় মেঘ ডমরু নিনাদে, নিভে যায় মঙ্গলদীপ সহস্র বাতিদানে,
ক্ষনপ্রভা বিজুরী আলোকে আলিঙ্গনপাশে বেঁধেছে সতীকে কে ও?
‘বিষ্ণুদেব!’ আর্ত চিৎকারে কেঁদে ওঠে পরম সাধিকা,
জলন্ধর শির ছিন্ন হয় ত্রিশূল আঘাতে কৈলাস ধামে;
নিষ্ঠুর উল্লাসে মাতে স্বর্গলোক, জয়ী হয় দেবত্ব নারীত্বের চরম অপমানে।

‘তোমাকে পূজেছি চিরকাল কায়মনে, এই তার পুরষ্কার?’
পাষাণমূর্তি সম বৃন্দার আক্ষেপ বিচলিত করে পুরুষশ্রেষ্ঠকে,
‘জগৎ কল্যাণ হেতু দায়বদ্ধ আমি ক্ষমা কর দেবী’ -
আত্মপক্ষ সমর্থনের নির্লজ্জ প্রচেষ্টায় বিড়ম্বিত স্বয়ং নারায়ণ।
‘আমি সামান্যা রাক্ষসী, দেবী নই, ক্ষমায় অপারগ,
পাষাণ-হৃদয় হরি, আভিশাপে মোর পাষাণে আবদ্ধ হবে তুমি,
যে কলঙ্কের কালি মাখালে আমায় আজি, সেই ঘোর কালো লাগুক তোমার অঙ্গে,
বিরহ, লাঞ্ছনা যত দিয়েছ আমায়, পাবে শতগুণে তুমি মানব জনমে’।
মশাল আলোকে যজ্ঞাগ্নি জ্বেলে, ঝাঁপ দেয় লাঞ্ছিতা বিরহিণী,
সাক্ষী থাকে দেব চরাচর।

বৃন্দার চিতাভস্ম জ্বালায় তুষাগ্নি মহেশ্বরের কোমল অন্তরে,
পবিত্র তুলসী বৃক্ষে পায় প্রাণ সতী বৃন্দা তাঁরই আশীষে;
‘কলঙ্কিনী নয়,বিষ্ণুপ্রিয়া হবে তুমি তুলসী সুন্দরী’, জানান বিষ্ণু অতঃপর।    
শালিগ্রাম শিলা রূপী নারায়ণ সাথে তুলসী বিবাহ ঘটে কার্ত্তিক একাদশীতে,
নারীত্বের অমর্যাদাপাশে বাঁধা পরেছেন পুরুষোত্তম চিরতরে,
তাই কি আজও সম্বৎসর,ঘটে তাঁর কলঙ্কমোচন তুলসী বিবাহে?

***

@অনন্যা পাল ২০১৫

মঙ্গলবার, ৬ অক্টোবর, ২০১৫

আশ্রয়

ঘরের লাগোয়া ব্যলকনিটা তার বড় প্রিয়।
সেই কোন ছেলেবেলায় বাবা মায়ের হাতধরে এই ফ্ল্যাটে উঠে আসা,
‘আজ থেকে এটাই আমাদের বাড়ি, আর এই ঘরটা তোমার’ –
কথাটা শেষ না হতেই, একছুটে পৌঁছে গেছিল নরম রোদ মাখা বারান্দাটায় ছোট্ট তিন্নি,
‘আর এটা?’ ‘এটাও তোমার’ বাবা হেসে কোঁকড়া চুলগুলো ঘেঁটে দিয়েছিলেন পরম আদরে।
সেই থেকে, বাড়ির এই বাড়তি কোনাটা তার একমুঠো আকাশ আর চিলতে রোদকে সঙ্গী করে
হয়ে ওঠে তিন্নির বড় আপনার,
একা একা এক্কাদোক্কা খেলা, গল্পের বইয়ে পাতায় হারিয়ে যাওয়া;
আর তারও পরে, লাল বাঁধাই খাতায় কবিতার আঁকিবুঁকি  –
এর সবকিছুই যে ওই বারান্দার নিশ্চিন্ত ঘেরাটোপে,
এই টুকরো জায়গাটুকু তার একান্ত নিজের,
যার ভাগ দেওয়া যায় না কাউকে।

রাস্তার ধারের কৃষ্ণচূড়া গাছটা ছায়া ফেলে বারান্দার রেলিঙে,
বাতাসে শুষ্কতার শিরশিরানি যেন আসন্ন শীতেরপূর্বাভাস;
সামনের পার্কটাতে পাঁজরা বের করে দাঁড়িয়ে আছে প্যন্ডেলের কাঠামো
উৎসব শেষে, হত-গৌরব ভাঙা দেউলির মত।
গাছের ডালে বসা কাকটাকে হুড়ো দিতে গিয়ে হেসে ফেলে তিন্নি,
এই চুয়াল্লিশে এসব বোধহয় মানায় না;
মানায় না তো আরও কতকিছুই -
ব্যাবসায়ী স্বামীর সাফল্যের চেয়ে তার ব্যভীচারকে বড় করে দেখা,
ছেলেটার ভবিষ্যৎ না ভেবেই এক কাপড়ে তেজ দেখিয়ে বেরিয়ে আসা।
বুড়ো বাপ মার কাছে ফিরে এসে সেই বাড়িটায় ওঠা, যা সে নিজের বলেই জানত,
ভারি বেমানান সেটাও আজ সকলের চোখে।
একটা দীর্ঘশ্বাস বাতাস ভারী করে দেয় আচমকা,
খর হয়ে ওঠে কার্তিকের নরম সকাল।

একটু পরে আসবে কোন্নগরের পিসি ডাক্তার গৃহিণী মেয়ে নিয়ে,
উপলক্ষ বিজয়ার শিষ্টাচার,তবে লক্ষটা যে তিন্নি সেটা সহজবোধ্য;
স্কুলের সব পরীক্ষায় এগিয়ে থাকা তিন্নিকে পেছনে ফেলে,
লাল টিপ আর জামদানীতে ঝলমলে ছোট বোন এখন ডার্বি জেতা ঘোড়া;
গলার কাছে দলা পাকিয়ে ওঠা কষ্টটাকে পেছনে ঠেলে দিতে গিয়ে ভেজে চোখ।
‘কা কা’ হেড়ে গলার হুঙ্কারে যুদ্ধের আহ্বান জাগিয়ে
প্রতিবাদী কাকটা রেলিঙে এসে বসে,
না চাইতেই ঠোঁটের কোন বেঁকে যায় হাসিতে,
কাকটার সাথে গলা মেলায় চুয়াল্লিশের তিন্নি,
ঝিরি ঝিরি বাতাসের দোলায় খসে পরে পাতা ঝুরো চুলের এলমেলো সিঁথিতে।
বারান্দাটা নতুন করে বড় কাছের মনে হয়,
শৈশবের স্বপ্নমাখা, নিশ্চিন্ত আশ্রয়।

***
অনন্যা পাল
৭ই অক্টোবর, ২০১৫