শুক্রবার, ২৫ আগস্ট, ২০১৭

ছাড়া কি যায়?

আমার ঢাকার বাড়ির বারান্দায় আলো আঁধারির ছায়া ফেলে ঝুঁকে আছে যে গাছটি,
বহুকালের চেনা বন্ধুর মতই তার উপস্থিতি , আমার এই তিনবছর ব্যাপী প্রবাস জীবনে;
নাম জানতে চাইনি কখনও, নামে কি বা আসে যায়?
গ্রীষ্মের দখিনা বাতাসে তার পাতায় ঢেউ, আমাকে ছুঁয়ে যায় আলতো আলিঙ্গনে,
বাদলা দিনের একলা দুপুরে সিক্ত পরশে সে জানায়, ‘পাশেই আছি’,
মন উঁচাটন বসন্তদিনে ডালপালা দুলিয়ে হাতছানি দেয় পরম আদরে।
আজ যাবার দিনে, তার চিকণ পাতার নরম সবুজে রয়ে যাবে আমারও একটু খানি,
ছাড়তে চাইলেই ছাড়া কি যায়?

গাছের ডালে, বারান্দার কার্নিশে নিত্য তার আনাগোনা, গলায় সাদা দাগ,
গল্পপ্রিয়, প্রতিক্রিয়াশীল এক বাঙ্গালিনী কাক;
আমার মত সেও একটি মেয়ের মা, মাতৃত্বের অনেক কিছু শিখেছি তার কাছে।
ছটফটে, চটপটে একজোড়া বুলবুলি, দূপুরের লেখালেখির মগ্নতার মাঝে,
পড়ার ঘরের কাঁচে, ঠোকর দিয়ে জানান দেয় গোপন অভিমানে,
আমারও আছি সাথে।
লক্ষ্মীমন্ত বেনেবউ কাঁচা হলুদ গা, হালকা পায়ে উড়ে বেড়ায় এডালে, ওডালে,
হোল না তো কমদিন, তবু আমার মুগ্ধতা আজও সেই প্রথম দিনের মতই।
চলে যেতে হবে সবাইকে ছেড়ে, তবু নিঃসঙ্গ দিনে আলো ছায়ার আঁকিবুঁকিতে, রয়ে যাব আমি;
ছাড়তে চাইলেই ছাড়া কি যায়?

চায়ের কাপ হাতে জানলায় বসলেই, দেখা যায় শ্যামলিমা ঘেরা বারিধারা ঝিল,
তার গহন গভীর জলে ডুব দিয়ে, কুড়িয়ে আনতে সাধ হয় জমে থাকা বহূযুগের কথা;
উজ্বল দিনে সোনা চিকচিকে ঢেউয়ে, পাল তোলে আমার সুদূর পিয়াসী মন।
ধ্যানগম্ভীর পূবের দিগন্তের গেরুয়া, ছুঁয়ে যায় আমার অন্তঃস্থল প্রতিদিন;
গোধূলির কোনে দেখা আলোয় দূরন্ত পশ্চিমী ক্যানভাস –
ধরে রাখি মনের লেন্সে ক্লান্তিহীন মুগ্ধতায়।  
আমি চলে যাব; তবু ঝিলের ঢেউ ছন্দহীন হবে না, সূর্যাস্তের রঙে আঁকা হবে নতুন কাহিনী;
শুধু আমার নিঃশ্বাস বাস্প, ভোরের শিশির হয়ে মূর্ত হবে জানলার কাঁচে;
ছাড়তে চাইলেই ছাড়া কি যায়?


***
©1917 ananyapal ALL RIGHTS RESERVED

শুক্রবার, ১১ আগস্ট, ২০১৭

জঙ্গল সাফারি ও গদাযুদ্ধ

কদিন আগে পতিদেব ও আমি জনা চারেক বন্ধু সমেত গেছিলাম কেনিয়ার জঙ্গলে; আমার জঙ্গলযাত্রা এই প্রথম, তাও একেবারে রোমহর্ষক মাসাইমারা, এযেন একলাফে গাছে ওঠা চারজনের মধ্যে দুজন বন্ধু ফোটোগ্রাফার; পতিদেবও ইদানিং ওইদলে নাম লিখিয়েছেন, অতএব সাফারি সফরের রোমাঞ্চ যে কি, সে বিষয়ে সম্বৃদ্ধ হতে হতে পৌঁছে গেলাম নাইরোবি এয়ারপোর্টে হাজির গাইড কাম ড্রাইভার কাকা (না আমার খুড়ো নয়), সাফারি জীপ সাথে নিয়ে; শুনলাম এই বাহনই সামনের সাতদিন হবে আমাদের পীঠস্থানও হরি, মাথাখোলা হাড়গিলে এই জীপে সারাদিন চেপে থাকলে পীঠের স্থানে কি অবশিষ্ট থাকবে ভেবে আমি ততক্ষণে হতভম্ব

যাইহোক, ভোর না হতেই প্রতিদিন বালিশ কাঁধে ফোটোগ্রাফারের দল (ওঁদের দাবি ওগুলো বিন ব্যাগ) জীপের পশ্চাদপট দখল করেন; বাকি দুই আনাড়ী সাথী নিরাপদ দূরত্বে সামনের দিকের সিটে, মুশকিল হোল আমাকে নিয়ে অবস্থার গতিকে আমাকে বসতে হয় ফোটোগ্রাফার দলের আওতার মধ্যে, পুরস্কার স্বরূপ কোনও জন্তু বা পাখী দেখলেই স্টপ স্টপবলে তারস্বরে চ্যাঁচানোর দায়িত্ব বর্তাল আমার ওপর চ্যাঁচ্যাঁতে আমি চিরকালই ওস্তাদ, কিন্তু গোল বাধল অন্য জায়গায় ফোটোগ্রাফারের দল গদাধারী ভীমের মত গদা, থুরী ক্যামেরা উঁচিয়ে সারাক্ষণ আস্ফালন করেন, একটা কিছু দেখা গেলো কি গেলোনা, তাঁদের রণহুঙ্কারে আমি তস্থ! একদিন ঝোপের ধারে দেখা মিলল সিংহমামার, একটা নয় গোটা তিনেক (জঙ্গল তো নয় মামারবাড়ী!); ফোটোগ্রাফার বাহিনী যথারীতি উত্তেজিত, নিজের মোবাইলে জানলা দিয়ে একটা ছবি তোলার চেষ্টা করতেই পতিদেবের গদারূপী ক্যামেরার বাড়িতে আমার ডান হাত অবশ এত নড়াচড়া করলে এই হয়স্বান্তনা বাক্য নয়, খ্যাঁকানি কানে এলো কিছুদূরে একটা সিংহছানা দেখে উত্তেজিত হয়ে দাঁড়াতে গেছি, ‘এ তো আচ্ছা বেকুব! লায়ন কাবের বদলে তোমার টুপীর ছবি নিয়ে বাড়ী যাব না কি?’ এক বন্ধু হুড়ো দিতে কাঁচুমাচু মুখে বসে পড়ি রাস্তার দুধারে দিগন্ত বিস্তৃত সাভানা ঘাসের ঢেউ, মাঝে মাঝে আকাসিয়া গাছ নয়নাভিরাম; এরই মধ্যে একটা গাছের মাথায় ঈগল দেখে যথারীতি স্টপবলে চেঁচিয়েছি গাড়ী থেমেছে কি থামেনি, বান্ধবীর ক্যামেরা তেড়ে এলো আমার মুখের ওপর ওরে মারা পড়ব যে!’, ‘সাফারিতে এসব একটু সহ্য করতে হয়’, আমার আর্তনাদের উত্তর মিলল একেই লগনচাঁদা মুখশ্রী, তায় গদাপ্রহারে তুবড়ে গেলে যে বেবুনরাও দলে নেবেনা, বোঝাই কাকে! এদিকে আর এক গেরো সামনে বসা দাদাকে নিয়ে, ভারি গোবেচারা দাদাটি ভালো কিছু দেখা গেছে কানে গেলেই উদ্ভ্রান্তের মত তাঁর দু-ফুটিয়া আইপ্যাডটি মেলে ধরেন; এভাবে তিনি ছবি কতদূর তুলতে পেলেন জানিনা, তবে গাড়ীর সামনের কাঁচ দিয়ে খালি চোখে কিছু দেখার আশাও আমায় ছাড়তে হোল একবার চিতা দেখা গেলো গাড়ীর সামনে, সবাই খুব উত্তেজিত; আমি অবশ্য আইপ্যাডের কালো ঢাকনার ওপর দুটো হলুদ কান দেখেই সন্তুষ্ট রইলাম সুখের কথা এই যে, দাদা আমার, সাফারিতে বেশীরভাগ সময় ঢুলেই কাটিয়েছিলেন

দুর্গম জঙ্গুলে রাস্তায় জীপের দোদুল দোলা, সাথে দুর্ধর্ষ ফোটোগ্রাফারদের জঙ্গী হামলা, এসব সয়ে জীবনের প্রথম সাফারি সফরের যে অভিজ্ঞতা আমার হোল, চাঁদের পাহাড়ে শঙ্করের অভিযানের থেকে তা কম কি সে! শুধু আমার অ-ফোটোগ্রাফার বন্ধুদের জন্যে একটা উপদেশ, ‘কুঁজোর চিৎ হয়ে শোয়ার চেষ্টা না করাই ভালো’; তারপরও নেহাৎ জঙ্গলে যেতে হলে সাথে বর্ম ও হেলমেট নিতে ভুলবেন না; আর হ্যাঁ বালিশও একটা নেবেন, না ছবি তুলতে নয়, পিঠে গুঁজতে কাজে দেবে  

***
©2017 ananyapal ALL RIGHTS RESERVED