বুধবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৪

বাহারে সমুদ্র বিহার

মেয়ের বিদেশী স্কুলে ক্রিস্টমাসের লম্বা ছুটি, বিদেশী বন্ধুরাও সব স্বদেশমুখী; অতএব ঢাকায় তার মন চঞ্চল। বললাম ‘আমরাও তো কোলকাতা যাবো, ছুটি বেশ কাটবে’, মেয়ে তার ওঁচানো নাক আরও উঁচিয়ে বলল ‘সেটা আবার বেড়ানো হোল? বন্ধুরা সব গেছে কোরিয়া, আফ্রিকা, আমেরিকা - আর আমি আধ ঘণ্টার রাস্তা কোলকাতা?’ কি বিপদ, তা বাঙালি হয়ে যখন জন্মেছ, হোম ভিসিট তো গুয়াটেমালা কিম্বা হনলুলুতে হবে না; তা সে কথা কে বোঝে! শেষমেশ বাবারূপী স্যান্টা উদ্ধারে নামলেন, ব্যাবস্থা হোল স্টার ক্রুসে সমুদ্রবিহারের সিঙ্গাপুর থেকে।

যাবার দিন, মাত্র ছঘন্টা লেট বিমান-বাংলাদেশে ‘চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে’ আবহ সঙ্গীত এবং বিকেল সাড়ে চারটেয় মাংস-ভাত ও পায়েসের মেনু দেখে যুগপৎ পুলকিত ও শিহরিত হলাম (অবশ্য ফেরার সময় সন্ধ্যে ছটাতেও মৌলিকত্ব বজায় রেখে বিরিয়ানি দেওয়া হয়েছিল এবং লোকে ভারি তৃপ্তি সহকারে তা খেয়েছিল)।
পরদিন সকালে হারবারফ্রন্ট জাহাজঘাটায় পৌঁছে মনে হোল যেকোনো আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট টার্মিনালকে লজ্জা দেবে। আমরা একটু আগেভাগেই পৌঁছেছিলাম, যাতে হুড়োহুড়ি না করতে হয়; পৌঁছে দেখলাম জনসমুদ্রের ঢল, কারন প্রায় ষাট শতাংশ যাত্রীই আমার মত ব্যাস্তবাগিশ ভারতীয়। যাত্রীরা ভারতীয় হলেও, কর্মকর্তারা কর্মঠ সিঙ্গাপুরি, তাই নিয়মের বেড়াজাল ডিঙিয়ে জাহাজে চড়তে বিশেষ বেগ পেতে হোল না । এতদিন ওসান লাইনার বইয়ে পড়েছি, আর টাইটানিক সিনেমাতে দেখেছি, এক আধবার সমুদ্র বক্ষে দূর থেকেও দেখেছি; এবার ভেতরে গিয়ে সত্যি চমক লাগার পালা, এতই সুন্দর আর বিলাসবহূল ব্যাবস্থা। প্রাইভেট ডেক অর্থাৎ ব্যালকনি সহ আমাদের কেবিনটা যেন সাজানো একটা পুতুল ঘর, আর তার সাথের স্নানঘর আরও মজার, ছোট্ট একটু জায়গার মধ্যে সবরকম সুবিধে কেমন কায়দা করে আঁটান হয়েছে না দেখলে বিশ্বাস করা শক্ত।

অর্ণব পোত
এতো নয় খেলাঘর

বারোতলা জাহাজের বিভিন্ন তলায় চেয়ার পাতা মনরম ডেক, অসংখ্য সুইমিং পুল, রেস্তরাঁ, ক্যাসিনো এবং চমকপ্রদ সব বিনোদনের বন্দোবস্ত। যাইহোক, জাহাজ পরিদর্শন শেষে ভরপেট চৈনিক আহার সেরে এগার তলার ডেক এ চেয়ারে লম্বা হলাম; ফুরফুরে হাওয়া, সামনে আ-দিগন্ত সমুদ্র, আর একটু দূরে ছোটো পুলে কয়েকটা চীনে বাচ্চার হুটোপুটি - দেখতে দেখতে কখন চোখ লেগে এসেছে বুঝতেই পারিনি। হঠাৎ একটা বাঁশফাটা চিৎকারে কলজে লাফিয়ে উঠল, আর তার সাথেই শুনতে পেলাম ঢাকের গুরু গর্জন। ব্যাপারটা ভালো করে ঠাহর করতে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি, তখনি চোখে পরল পুলের সামনে একটা ছোটো খাটো জটলা; আর সেই জটলার মধ্যমণি এক চীনে মহিলা এবং তাঁর এক দেশোয়ালি ষণ্ডা জোয়ান। নিঃসন্দেহে, শব্দ তরঙ্গের যুগলবন্দী এঁদেরই অবদান; তবে ব্যাপারটা বেশীক্ষন শুধু শব্দযুদ্ধেই থেমে রইলো না, অচিরেই পুরুষটি গলাবাজিতে পিছু হটে ঘুসি পাকাতে শুরু করল, লক্ষ অবশ্যই চিনে বিরাঙ্গনা। মহিলা তাতে দমবার নন, তাঁর কর্ণভেদী তারানা আমাদের সাথে সাথে প্রতিপক্ষ পুরুষটিকেও পর্যুদস্ত করে দিচ্ছিল। বুঝলাম জেন্ডার ইকুয়ালিটিতে চীনেরা আমাদের থেকে ঢের এগিয়ে। এবারে কৌতূহল দমন করতে না পেরে একটু খোঁজ করে মালুম হোল এঁরা পুলের খেলুড়ে দুটো বাচ্চার যথাক্রমে মা ও বাবা। বাচ্চা দুটি খেলতে গিয়ে নিজেদের মধ্যে কিছু নিয়ে ঝগড়া শুরু করে এবং মৌখিক ঝগড়ায় সুবিধে করতে না পেরে মহিলার ছেলে তার ফ্লোটারটা অন্যজনের মাথায় ভাঙে, তারই ফলে এই কুরুক্ষেত্র । যাহোক, খানিক বাদে জাহাজকর্মীদের হস্তক্ষেপে মিটমাট হোল, মহিলা অপরপক্ষের শাসানি উপেক্ষা করে ভাঙা ফ্লোটার হাতে দুর্ধর্ষ ছেলেকে নিয়ে ডেক দাপিয়ে চলে গেলেন, পিছু পিছু যাওয়া নিরীহ জীবটিকে দেখে বুঝলাম মহিলার স্বামী যাকে এতক্ষন চোখে পরেনি। বাঙালি স্বামীদেরই শুধু স্ত্রৈণ অপবাদ দেওয়া নিতান্ত অন্যায় সন্দেহ রইলো না।  

ডেক থেকে তোলা

জলকেলি

জাহাজের ডেক
রেস্তোরাঁ
ভারতীয় যাত্রিরা প্রধানত দুধরনের, একাংশ অবশ্যই মধুচন্দ্রিমা যাপনে ক্রুজে, তাদের মধ্যে উত্তর পশ্চিম ভারতের আধিক্য; আর একটা বড় অংশ গুজরাতি, যারা বাবা-মা, ছেলে-বউ, নাতিনাতনি সহ পরিবারকেন্দ্রিক ভ্রমনে এসেছেন। এক্ষেত্রে যে জিনিসটা সবচেয়ে লক্ষ করার মত, তা হোল বয়স, চেহারা ও আয়তন নির্বিশেষে খাটো পশ্চিমি পোশাকের চূড়ান্ত সমারোহ। এব্যাপারে, তন্বী নববধূ এবং মেদবতী আন্টি সব একাকার এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একের সাথে অন্যের পোশাকের ভীষণ মিল, যা দেখে অনেকবার একথাও মনে হচ্ছিলো যে পোশাকগুলো সম্ভবতঃ একই দোকানের। তা ডেক এ বসে মহিলাদের খাটো পোশাকের র‍্যাম্প ওয়াক দেখতে মন্দ লাগছিল না, যদিও তার মাঝে দু একটা ছোটোখাটো দুর্ঘটনা ঘটেছে। সে প্রসঙ্গে যাবার আগে একটা কথা বলে রাখি, ভারতীয় যাত্রীরা ডেক এ বসে সময় নষ্ট না করে সকাল থেকে রাত সুইমিং পুল, জাকুসি এবং ফ্রী রেস্তোরাঁতেই ভীড় করতেন। এবার আসা যাক দুর্ঘটনার কথায়। মাঝ সমুদ্রে প্রাক-সন্ধ্যায়, বারোতলার ডেক এ দুরন্ত হাওয়া, আমি যথারীতি ডেক চেয়ারে আধশোয়া; একটু দূরে রেলিং ঘেঁসে দাঁড়িয়ে নানান ভঙ্গিমায় ছবি তুলছে এক নবদম্পতি। আমার মত, কিছু দূরে খোলা রেস্তরাঁয় বসা এক মধ্যবয়সী দম্পতিও ওদের লক্ষ করছিলেন; কিছু পরে দেখি ভাবিজি উঠে গিয়ে দাড়ালেন রেলিং ধরে, ক্যামেরা তাক হতেই এক অভাবনীয় মুহূর্ত – ভাবীর ফ্রক উড়ে একেবারে মরিলিন মুনরো, তফাতটা শুধু আয়তনে। জাহাজের প্রতিটি ডেক এর চার কোনায় একটা করে জাকুসি সকাল থেকে রাত চালু থাকতো এবং যথারীতি এর প্রত্যেকটিই বেশিরভাগ সময় থাকতো ভারতীয়দের কবলে। দুপুর নাগাদ সেরকম একটি জাকুসি থেকে এক প্রায় বৃদ্ধা দশাসই আন্টি বেরিয়ে এলেন, উদ্দেশ্য ডেক এর অন্য প্রান্তে চেঞ্জিং রুমে যাওয়া। সুইমিং কস্টিউমে অনভ্যস্ত আন্টি দুটি তোয়ালে দিয়ে সর্বাঙ্গ ঢেকে চলেছেন ব্যাস্ত পায়ে, মাঝ বরাবর পৌঁছে হঠাৎ নিম্নাঙ্গের তোয়ালেটি গেলো খুলে; এর পরের দৃশ্য বর্ণনা করার দুঃসাহস আমার নেই।    

এবার আসি জাহাজের বিভিন্ন বিনোদন মূলক অনুষ্ঠানের কথায় (আমার অবশ্য ডেক এ বসেও বিনোদনের অভাব হয় নি)। আন্তর্জাতিক জাহাজের বিনোদনও সম্পূর্ণ আন্তর্জাতিক ও পক্ষপাত বর্জিত, সেখানে কোরিয়ান কমেডি, ব্রাজিলিয়ান নাচ থেকে বলিউড নাইট কিছুই বাদ যায় নি। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল জাহাজের ক্রু মেম্বারদের একটি অনুষ্ঠান, সেখানে হিন্দি গান, ব্যালে নাচ, হিপ হপ এমনকি জাগলারি শো দেখে এরা যে পেশাদার নয় ভাবতে অসুবিধা হচ্ছিলো। চারটি চিনে মেয়ে ভারি সুন্দর একটি চিনে গান গাইতে গাইতে স্টেজে এলো, সুরটা কেমন চেনা চেনা; আমার মেয়ে খুব কোরিয়ান গান শোনে তাই ওকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম ওটা অতিপরিচিত হিন্দি গান ‘ছাঁইয়া ছাঁইয়া’, চিনে উচ্চারণের গুণে যা অমন আন্তর্জাতিক মাত্রা পেয়েছে। অনুষ্ঠানের শেষ আইটেম ছিল তিন ‘ডিভা’ র ইঙ্গিতপূর্ন ফ্যাশন ওয়াক, আমাদের আইটেম গার্লরা যার কাছে নেহাতই জোলো। পরদিন সকালে ব্রেকফাস্টে রেস্তোরাঁর একটি ওয়েট্রসের কাছে অনুষ্ঠানের প্রশংসা করায় সে একটি ওয়েটার ছেলেকে এনে হাজির করল, ‘তুমি কিসে ছিলে?’ জিজ্ঞাসা করায় ছেলেটি লাজুক হেসে জানালো সে ওই তিন সুন্দরীর একজন। বলাই বাহুল্য এরপর আমি বাকশক্তি রোহিত।  

বলিউডেও আছি
চীনে 'ছাঁইয়া ছাঁইয়া'

সফর শেষে জাহাজ থেকে নামার সময় মনে হোল একটা মনকেমন করা অনুভুতি এই বিশাল ক্রুজের কোন ও এক কোনায় ফেলে এলাম, আর তার বদলে সঙ্গে নিয়ে এলাম একরাশ বিস্ময়, ভাললাগা আর কিছু অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা।


***