শুক্রবার, ১৭ অক্টোবর, ২০১৪

হাসতে নেই মানা......


হাসতে নেই মানা......                   

মে মাসের প্রথম সপ্তাহ, পচা গরমে শরীর হাঁসফাঁস । অভিজাত স্কুলের গাছপালা ঘেরা খোলামেলা বিল্ডিং তাই রক্ষে; তবে গরমের ছুটির আর মোটে দিন দুয়েক অপেক্ষা তার পর আর পায় কে! টেনের ক্লাসরুমে বসে একমনে পেন্সিল চিবুতে চিবুতে সে কথাই ভাবছিলাম । সদ্য শেষ হওয়া হাফ ইয়ারলি পরীক্ষার খাতা টাতা বেরচ্ছে তাই বেশ একটা চাপা উত্তেজনা, আমি অবশ্য ‘রাগ দুঃখ ভয় তিন থাকতে নয়’ গোছের দর্শনে বিশ্বাসী তাই আপাততঃ মা টিফিনে কি দিয়েছে সেই নিয়ে গবেশনায় ব্যাস্ত । ইতিহাসের দিদিমণি মিসেস রয় ক্লাসে ঢুকলেন, হাতে যথারীতি উত্তরপত্রের গোছা । ‘এগুলো তোমাদের নয়, তোমরা কাল পাবে’ ব্যক্তিত্বময়ী সদাপ্রসন্না দিদিমনি আজ মনে হোল তেমন প্রসন্ন নন । নিজের জায়গায় বসে গম্ভীর মুখে জানতে চাইলেন ‘X-A র মিতালী বসু কে চেন তোমরা?’ চুপচাপ নিরীহ মিতালী হঠাৎ এত বিখ্যাত কি করে হোল ভাবার চেষ্টা করছি, দিদি নিজেই ব্যাপারটা খোলসা করলেন । ‘একটু আগে মিতালীর খাতা চেক্ করছিলাম, তাই ওর সম্বন্ধে আগ্রহ বোধ করছি’ । আমি তো শুনে থ! মিতালী তো জানতাম পড়াশোনায় আমার থেকেও সরেশ, এর আগে আমরা এক সেকশানে পড়েছি; কলিকালে কত কি যে দেখব! ‘তোমাদের এখন মিতালীর খাতা থেকে সম্রাট কনিষ্কের ওপর যে প্রশ্ন ছিল তার উত্তর পড়ে শোনাচ্ছি, মন দিয়ে শুনে বলবে কি বুঝলে’ । উত্তেজনায় এবং খনিক ঈর্ষায় আমার পেটের ভেতর গুড়গুড়, যাই হোক দিদিমণি তাঁর উদ্দাত্ত গলায় শুরু করলেন ।
‘কনিষ্ক অনেক দিক থেকেই আর সব সময়কালীন রাজার থেকে আলাদা ছিলেন এবং তার প্রথম কারণ হল তিনি মুণ্ডহীন ছিলেন । মুণ্ডহীন হওয়া সত্তেও বুদ্ধিতে ও পরাক্রমে অন্য মুন্ডওয়ালা রাজাদের থেকে কোনও অংশে কম ছিলেন না । যুদ্ধক্ষেত্রে যখন শত্রু তাঁকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলত, বিনা মুণ্ডেও তিনি অর্জুনের মতই লক্ষভেদ করতে পারতেন । শুধু তাই নয় মুণ্ডহীনতা সত্তেও তিনি সঙ্গীত ও সাহিত্যের অনুরাগী ছিলেন । শুধু একটা বিষয়েই তাঁর বিশেষ অসুবিধে ছিল, মুণ্ড না থাকায় সম্রাটের মুকুট মাথায় পরার সুবিধে ছিল না, তবে মনে হয় সেটা তিনি কোমরবন্ধে ঝুলিয়ে কাজ চালিয়ে নিতেন’  -
বাকিটা শোনার মত অবস্থা তখন ক্লাসের কোনও মেয়েরই আর নেই, উদ্বেলিত হাসি চাপার অসীম চেষ্টায় সকলের মুখ লাল । আমি মনে মনে ক্ষনজন্মা মিতালী কে স্যালুট না জানিয়ে পারলাম না । শুধু দিদিমনির মুখে থমথমে গাম্ভীর্য, ‘এটা কি আমাকে অপমানের চেষ্টা?’ উনি দেখলাম ব্যাপারটা ব্যাক্তিগত পর্যায়ে নিয়ে গেছেন । নিরীহ, ল্যাকপ্যাকে মিতালীকে আর যাই হোক ঠিক অপমানকারিনী হিসেবে ভাবতে পারলাম না ।
***
প্রসঙ্গতঃ বলে রাখি, সম্রাট কনিষ্কের একটি মাত্র প্রতিকৃতি মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেছে, সেটি কালের প্রবাহে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে মুণ্ডহীন ছিল । ফলে ইতিহাসের বইয়ে তাঁর যে ছবি পাওয়া যায়, সেটি সেই মুণ্ডহীন ধরের প্রতিকৃতি । 

Publishied in Prothom Alo on 11th December, 2015

মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর, ২০১৪

অপরূপা

সেদিন পড়ন্ত বিকেলের কনে দেখা আলোয়
প্রথম তেমন করে দেখেছিলাম তোমায়,
ধীর পায়ে ঘরমুখো একাকিনী;
ললিত ছন্দে সুরেলা কোন ও সন্ধ্যা রাগিনী ।

ইশৎ হেলে থাকা এলোখোঁপা, সরু মফচেন, হাল্কা রঙের শাড়ী;
দিঘীর স্নিগ্ধতা মাখা চোখ, ফর্সা গাল ছুঁয়ে আছে ঝুরো চুল দলছুট, আনাড়ী ।

গোধূলী বেলার নিবিড় অস্তরাগে,
আমার হৃদয়ে বেহাগের সুর বেজেছিল নীরবে ।

আজ ও বসন্ত আসে,
কৃষ্নচূড়ার রাঙা ফাগ ওড়ে দখিনা বাতাসে;

আজ ও বাঁধভাঙা মন চকিত পলকে উৎসুকে চায় পথের বাঁকে,
গোধূলী আলোর লালিমায় খোঁজে সে এক অপরূপাকে।

বুধবার, ১ অক্টোবর, ২০১৪

কাকচক্ষু

তেজী ঘোড়ার মত মেয়েটি সব কিছুতেই ফার্স্ট;
রেসের পাল্লায় অথবা ক্লাসের পরীক্ষায় –
তার নাগাল পাওয়া শক্ত, হেলায় জেতা যেন এক মুদ্রাদোষ মাত্র ।
যেমন বিতর্কের ধার, তেমনই গানের সুরে মীর ঠাঁট,
বড় অনায়াস, সহজে লালিত।
শিক্ষিকাদের স্নেহে, সহপাঠিনীদের অবাক বিস্ময়ে,
বাবা মা দাদু দিদার নিরব অহঙ্কারে; সে যেন হেমন্তের আকাশপ্রদীপ ।
স্কুলের গণ্ডি, প্রাক্ কলেজের ঘেরাটোপ, ডার্বির কায়দায় রঙিন নিশান উড়িয়ে
সবখানে তারই জয়জয়কার ।

তখন বসন্ত দিন, বাতাসে ভালো লাগার সুর;
কলেজ পড়ুয়া মেয়েটির চলার ছন্দে রূপক, চাহনিতে মায়াবি জোছনা ।
একদিন হঠাৎ খবর এলো তার নেই কোনও খবর, সকালে কলেজ গিয়ে ফেরেনি আর;
চিন্তায় একশেষ বাবা মা, জল্পনার চুড়ান্তে প্রতিবেশী ।
দুদিন পরে ফোন, ‘মা ভালো আছি, বিয়ে করেছি; জামাই তোমার বিদ্বান নয় সামান্য চাকুরে। তবু ভাল আছি, যদি অনুমতি দাও যুগলে বাড়ী আসি’ ।
‘পড়াশোনা ছেড়ে পুতুলখেলার সাধ, এই যদি মনে ছিল; ধরে নেব মেয়ে নেই আমার’ -
মা নয় জবাব দিলেন বাবা ।
স্কুলের বান্ধবী এক নির্জন দুপুরে দেখতে গেলো তাকে,
দেয়ালে নোনা ধরা জলছবি, কপালে ঘামে লেপা সিঁদুর –
‘পড়াশোনা? আর গান?’...... ‘কি হবে ওসবে, বেশ আছি’ ।
‘বেশ থাকা যাবে কি চিরকাল?’ বান্ধবী বিদায় নেয়, চোখে তার জল ।

এরপর কেটে গেছে প্রায় দু-যুগ......
কোনও এক শনিবারের সন্ধ্যে, শপিং মলের অলিতে গলিতে অলস বিচরণ ।
সপ্তাহ ভর অফিস, বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা, সন্তান; তুলনায় সপ্তাহান্ত বড় ফাঁকা;
আর সে ফাঁক ভরাতে এই অভ্যাসের কেনাকাটা ।
‘হিমানী... হিমানী তো?’ গোলগাল এক আটপৌরে গিন্নি এগিয়ে এলেন,
চোখের চাহনিতে একরাশ সঙ্কোচ ।
সাদামাটা ধনেখালি, অজত্নে বাঁধা এলোখোঁপা, সাজ বলতে একটা সিঁদুরের টিপ;
আধুনিকা ঝলমলে হিমানী মেলাতে পারে না পরিচিত গণ্ডীর সাথে ।
‘আপনাকে তো ঠিক...’ কয়েক মিনিটের সংশয়, তারপর দীর্ঘ ফ্লাশব্যাক,
কুড়ি বছরের সফর মুহূর্তেই পার ।
‘তুই!’...... ‘চিনতে পেরেছিস?’ একগাল হাসিতে ঝলসে ওঠে সেই কবেকার দুরন্ত মেয়ে ।
এরপর ফুডকোর্ট, একে অন্যের জীবনের হিসেব দেয়ানেয়া;
ছেলে মেয়ে স্বামীর ভরা সংসারে হারিয়ে গেছে কবেই সেদিনের ডার্বি জেতা ঘোড়া ।
‘ভারি ছিমছাম লাগছে তোকে, সময় বাড়িয়েছে জৌলুস’ মুগ্ধতা ঝরে পরে মেয়েটির কথায়;
বান্ধবীর সাফল্যে তার অবাক বিস্ময় ।
‘এসবই তোর হোত, হয়তো বা আরও বেশী, কেন সরে গেলি?’ হিমানীর স্বরে আর্তি;
‘ক্ষতি কি, বেশ আছি’ মৃদু জবাব, সাথে আধো হাসি ঠিক আগের মতই ।

‘এবার উঠতে হবে রে, কিছু কাজ আছে’ উকিলের সাথে আপয়েন্টমেন্টের কথা ভেবে মসৃণ কপালে বিরক্তির ভাঁজ;
মিউচুয়াল ডিভোর্স, যার আর এক নাম দরকষাকষি, ছুটির দিনে হিমানীর একমাত্র ব্যস্ততা ।
মাথায় পাতলা হয়ে আসা কাঁচাপাকা চুল, নেহাতই ছাপোষা লোকটি হাসিমুখে এসে দাঁড়ায়;
‘আমার স্কুলের বান্ধবী’ - পরিচয় শেষে সলজ্জ সম্ভাষণ ।
তারাভরা আকাশের ঝিকমিকে আলোয় দূরে চলে যাওয়া মেয়েটির দিকে চেয়ে ভাবে, ‘বেশ আছে’; আজ হিমানীর চোখের কোলেও তারার ঝিকমিক।

***