বুধবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

পিরীতি বিষম জ্বালা

প্রেমে পরাটা বাঙ্গালীদের একটা বাতিকের মত, বিভিন্ন বয়সে একেক রকম ভাবে দেখা দেয় । যেমন স্কুলে পরতে ভীতুভীতু প্রেম, আবার কলেজ জীবনে কবিতা লেখার তাগিদে মরীয়া প্রেম। তাছাড়া ধরুন, পাশের বাড়ির নতুন ভাড়াটেদের সুন্দরী মেয়েটিকে দেখে জানলার পাশে ঘাঁই দিয়ে বসে উদাসী প্রেম; অথবা বাস স্ট্যান্ডে রোজ দেখা মেয়েটির পিছু নিয়ে তার বাড়ী অবধি ধাওয়া করে দুরন্ত প্রেম এব্যাপারে আপামোর বাঙ্গালিরই কিছু না কিছু অভিজ্ঞতা থাকতে বাধ্য, তার কিছু টক, কিছু মিষ্টি আর কারো কারো কপালে হয়ত শুধুই তেঁতো । তবে একথা স্বীকার করতে বাধা নেই যে আমার প্রেম বিষয়ক অভিজ্ঞতা শুধু অপূর্ব নয় সম্ভবতঃ অভূতপূর্বও এবং যতরকম প্রেম বাঙ্গালির সহজাত তার প্রায় প্রত্যেকটিই আমার ঝুলিতে বর্তমান 
একেবারে গোড়া থেকে শুরু করলে ব্যাপারটা বেশ ফরসা হবে। তখন পড়ি ক্লাস সেভেনে, আমার প্রিয় বান্ধবী গরমের ছুটিতে মামাবাড়ি গিয়ে প্রেমে পরলেন। প্রেমে তো শুধু পরলেই হয়না তাকে জল-সার দিয়ে টিঁকিয়ে রাখাও চাই; আর সমস্যাটা বাধল সেখানেই। কারণ মামাবাড়ি কোলকাতার বাইরে, পত্রালাপ ছাড়া গতি নেই। এদিকে বাড়িতে চিঠি এলে ধরা পরার ভয়। অতএব অগতির গতি এই শর্মা, বন্ধুর প্রেমকে মসৃণ করার মহৎ কাজে তখন আমাকে ঠেকানো দায়। নিজের বাড়িতে চোরের মত পরের চিঠির আশায় ওঁত্ পেতে থাকি, আর কাঙ্খিত সুগন্ধি রঙিন খামটি এলেই চিলের মত ছোঁ মারি পিওনের কাছ থেকে। এভাবে চলছিলো বেশ (অন্তত আমার বন্ধুর হাবেভাবে তো তাই মনে হোতো), বিপদ এল অন্য দিক থেকে। এক রোববার একটা ফোন আসার পরই বাবা গম্ভীর মুখে ডেকে জানতে চাইলেন কবে থেকে পরের কালোয়াতিতে পোঁ দিচ্ছি (ভাষাটা এক না হলেও বক্তব্যটা প্রায় তাই ছিল)? ‘প্রাণ যায় পর বচন না যায়’ কায়দায় চুপ করে থেকে সেদিন দুর্গতির একশেষ, অন্ততঃ বামাল সমেত ধরা পরা বান্ধিবীর থেকে তো কম নয়ই। যাই হোক এর পর বান্ধবীর প্রেমরোগ তো সারল, কিন্তু আমার?
আমার পোঁ দেওয়ার সেই শুরু, বান্ধবীদের হয়ে অর্ডারি প্রেমের-চিঠি লেখা এবং তার জবাব এলে আরও জুতসই একটা প্রত্যুত্তর দেওয়া আমার সাহিত্যচর্চার (যা কিনা বাঙ্গালির আর একটা বাতিক) একটা গুরুতর অঙ্গ হোল; অবশ্য এব্যাপারে উৎসাহ দিয়ে গাছে ওঠাতে বন্ধুরা কোনও ত্রুটি রাখেনি। তবে আমার সাহিত্যকীর্তি অন্য মাত্রা পেল বেশ কিছুদিন পরে। এক বান্ধবী তার অর্ডারি চিঠি আমার থেকে নিয়ে গিয়ে কপি না করে সিধা পাঠিয়ে দিতে লাগলো প্রেমিক প্রবরকে (প্রেমের ব্যাস্ততায় নষ্ট করার মত সময় কোথায়?)একদিন সেও চিঠি পাঠানোর আগেই বামাল সমেত গ্রেপ্তার; এক্ষেত্রে গোয়েন্দাটি তার দিদিচিঠিতে আমার ভুবনমোহিনী হাতেরলেখা চিনতে ভুল হবার নয় আর তা হোলও না। ফলে সেবার প্রানের সাথে কান নিয়েও জবর টানাটানি।  
এবার আসি কলেজ প্রেমের কথায়। তখন সবে ফার্স্ট ইয়ার, এক শীতের সকালে আমার বেস্টফ্রেন্ড (বন্ধু, বান্ধবী নয়) হন্তদন্ত হোয়ে টেনে নিয়ে গেলো লেডিস কমন রুমের সামনে। ‘ব্যাপার কি?’ আমি খানিক ভ্যাবাচ্যাকা। ‘নন্দিনী এখুনি ঢুকেছে, আমি দেখেছি’ বন্ধুর ধোঁয়াটে জবাব। ‘তাতে আমাদের কি?’ ‘আরে অনেক কিছু। শিগগিরই গিয়ে আমার নাম করে ফোন নম্বরটা চেয়ে নে’। ‘আমি কেন নিজে নে না’ আমার সরব প্রতিবাদ। ‘আরে গাধা লেডিস রুমে আমি ঢুকলে সবাই মিলে চামড়া গুটিয়ে নেবে না?’ বন্ধুর যুক্তি অকাট্য, কদিন আগে আমিই এহেন ঘটনার সাক্ষী ছিলাম (বেচারা নতুন পড়ুয়াটি পাশের টিচার্স রুমের সাথে গুলিয়ে ফেলেছিল)। আমি এরপরেও গাঁইগুঁই করছি, প্রধানতঃ নন্দিনীর ডাকসাইটে উন্নাসিকতার কারণে। ‘ইয়ে ইশক নেহি আসান,এক আগ কা দরিয়া হ্যায়, অউর ডুবকে জানা হ্যায়’ বন্ধু গর্জে উঠল। ‘কিন্তু ইশক তো তোর, আগুনের সমুদ্রে আমি কেন?’ আমার মিনমিনে জবাবের তোয়াক্কা না করে আমাকে ও প্রায় ঠেলে চালান করে দিলো ভেতরে, শুধু তাই নয় দরজার সামনে পাহারায় রইলো যাতে পালিয়ে যেতে না পারি। নিজের বন্ধুভাগ্যে এতদিন পরেও আমি নিজেই রোমাঞ্চিত।
‘হাই! আমি সেকশান-এ’। ‘জানা আছে, নন্দিনীর কাঠখোট্টা জবাব। আমি আরেকটু ঘন হবার জন্যে দুএকটা কথা বলি যা নিজের কানেই অত্যন্ত বোকাবোকা ঠেকে। নন্দিনী আমাকে ঝেড়ে ফেলে মন দেয় নিজের সাজসজ্জার দিকে। ‘তুমি সুমন্তকে চেনতো? তোমাদের সেক্সানের’। আমি প্রসঙ্গে আসার জন্যে মরীয়া। ‘হু কেয়ারস্’! ‘না মানে ও তোমার সাথে বন্ধুত্ব করতে চায়’। ‘কিন্তু আমি চাইনা’। ‘কেন? ও কিন্তু খুব ভালো ছেলে’। সুপারিশের উত্তরে আমার পেছনের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে নন্দিনীর জবাব, ‘ভালো মানে তো ক্যাবলা, না হলে এধরনের প্রিমিটিভ ফ্রেন্ড জোটায়’। কানে আগুন, চোখে জল নিয়ে আমি কমন রুমের বাইরে

নিজের ইশক আসান কিনা জানিনা, তবে বন্ধুর ইশক যে পুরোপুরি আগুনের সমুদ্র তা আমার চেয়ে কেউ বেশি জানে না।

***

মঙ্গলবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

ফিরে দেখা

একটা ছোট্ট মেসেজ হোয়াটস আপে, ‘কবে আসবি, তোকে বড় দেখতে ইচ্ছে করে’ -
বদলে দিলো আমার ব্যাস্ততার সকাল এক লহমায়;
আছি কারো মনে, এই ভাবনায় আটপৌরে আমি কেমন নতুন হলাম নিজের কাছেই ,
শুরু হোল দিন গোনা । 
ফ্লাইট দমদমের মাটি ছোঁয়া থেকেই বুকের ভেতর ধুকপুক  –
‘দেখা হবে তো?’
 কেজো ছুটোছুটি, বিরামহীন দায়বদ্ধতা;
তবু তারই মাঝে কয়েকটা মেসেজ আর রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা ।

নতুন গড়ে ওঠা মাল্টিপ্লেক্সের প্রবেশদ্বারে পৌঁছে গেছি বেশ খানিক আগেই,
কিছু উদ্বেগ, কিছুটা রোমাঞ্চ মনে করিয়ে দেয় সেই প্রথম যৌবন;
চিনতে পারব তো, আমাকে চিনবে তো? - কত না সংশয়;
অনেক ভিড়ের মাঝে কয়েকটা চেনামুখ, মুহূর্তে শুরু টাইম মেশিনের সফর ।
অনাবিল হাসি আর অফুরান কথায় ভরা কয়েক ঘণ্টা পার হয় পলকেই;
স্মৃতির রোমন্থনে ফিরে দেখা সেই কবেকার ছোটবেলা –
বড় মধুর, স্বপ্নময় ।

‘দেখা হবে আবার’ বেলা শেষের প্রতিশ্রুতি  নয় কোনও বিদায় সম্ভাষণ;
একে অন্যের প্রতি এ যেন প্রানের অঙ্গীকার ।
ফিরে দেখার সেই বিকেল ঝুলিতে ভরে দিলো অনেক কিছু  –
জানি সে যে ফুরোবার নয় ।।


***