বুধবার, ১ অক্টোবর, ২০১৪

কাকচক্ষু

তেজী ঘোড়ার মত মেয়েটি সব কিছুতেই ফার্স্ট;
রেসের পাল্লায় অথবা ক্লাসের পরীক্ষায় –
তার নাগাল পাওয়া শক্ত, হেলায় জেতা যেন এক মুদ্রাদোষ মাত্র ।
যেমন বিতর্কের ধার, তেমনই গানের সুরে মীর ঠাঁট,
বড় অনায়াস, সহজে লালিত।
শিক্ষিকাদের স্নেহে, সহপাঠিনীদের অবাক বিস্ময়ে,
বাবা মা দাদু দিদার নিরব অহঙ্কারে; সে যেন হেমন্তের আকাশপ্রদীপ ।
স্কুলের গণ্ডি, প্রাক্ কলেজের ঘেরাটোপ, ডার্বির কায়দায় রঙিন নিশান উড়িয়ে
সবখানে তারই জয়জয়কার ।

তখন বসন্ত দিন, বাতাসে ভালো লাগার সুর;
কলেজ পড়ুয়া মেয়েটির চলার ছন্দে রূপক, চাহনিতে মায়াবি জোছনা ।
একদিন হঠাৎ খবর এলো তার নেই কোনও খবর, সকালে কলেজ গিয়ে ফেরেনি আর;
চিন্তায় একশেষ বাবা মা, জল্পনার চুড়ান্তে প্রতিবেশী ।
দুদিন পরে ফোন, ‘মা ভালো আছি, বিয়ে করেছি; জামাই তোমার বিদ্বান নয় সামান্য চাকুরে। তবু ভাল আছি, যদি অনুমতি দাও যুগলে বাড়ী আসি’ ।
‘পড়াশোনা ছেড়ে পুতুলখেলার সাধ, এই যদি মনে ছিল; ধরে নেব মেয়ে নেই আমার’ -
মা নয় জবাব দিলেন বাবা ।
স্কুলের বান্ধবী এক নির্জন দুপুরে দেখতে গেলো তাকে,
দেয়ালে নোনা ধরা জলছবি, কপালে ঘামে লেপা সিঁদুর –
‘পড়াশোনা? আর গান?’...... ‘কি হবে ওসবে, বেশ আছি’ ।
‘বেশ থাকা যাবে কি চিরকাল?’ বান্ধবী বিদায় নেয়, চোখে তার জল ।

এরপর কেটে গেছে প্রায় দু-যুগ......
কোনও এক শনিবারের সন্ধ্যে, শপিং মলের অলিতে গলিতে অলস বিচরণ ।
সপ্তাহ ভর অফিস, বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা, সন্তান; তুলনায় সপ্তাহান্ত বড় ফাঁকা;
আর সে ফাঁক ভরাতে এই অভ্যাসের কেনাকাটা ।
‘হিমানী... হিমানী তো?’ গোলগাল এক আটপৌরে গিন্নি এগিয়ে এলেন,
চোখের চাহনিতে একরাশ সঙ্কোচ ।
সাদামাটা ধনেখালি, অজত্নে বাঁধা এলোখোঁপা, সাজ বলতে একটা সিঁদুরের টিপ;
আধুনিকা ঝলমলে হিমানী মেলাতে পারে না পরিচিত গণ্ডীর সাথে ।
‘আপনাকে তো ঠিক...’ কয়েক মিনিটের সংশয়, তারপর দীর্ঘ ফ্লাশব্যাক,
কুড়ি বছরের সফর মুহূর্তেই পার ।
‘তুই!’...... ‘চিনতে পেরেছিস?’ একগাল হাসিতে ঝলসে ওঠে সেই কবেকার দুরন্ত মেয়ে ।
এরপর ফুডকোর্ট, একে অন্যের জীবনের হিসেব দেয়ানেয়া;
ছেলে মেয়ে স্বামীর ভরা সংসারে হারিয়ে গেছে কবেই সেদিনের ডার্বি জেতা ঘোড়া ।
‘ভারি ছিমছাম লাগছে তোকে, সময় বাড়িয়েছে জৌলুস’ মুগ্ধতা ঝরে পরে মেয়েটির কথায়;
বান্ধবীর সাফল্যে তার অবাক বিস্ময় ।
‘এসবই তোর হোত, হয়তো বা আরও বেশী, কেন সরে গেলি?’ হিমানীর স্বরে আর্তি;
‘ক্ষতি কি, বেশ আছি’ মৃদু জবাব, সাথে আধো হাসি ঠিক আগের মতই ।

‘এবার উঠতে হবে রে, কিছু কাজ আছে’ উকিলের সাথে আপয়েন্টমেন্টের কথা ভেবে মসৃণ কপালে বিরক্তির ভাঁজ;
মিউচুয়াল ডিভোর্স, যার আর এক নাম দরকষাকষি, ছুটির দিনে হিমানীর একমাত্র ব্যস্ততা ।
মাথায় পাতলা হয়ে আসা কাঁচাপাকা চুল, নেহাতই ছাপোষা লোকটি হাসিমুখে এসে দাঁড়ায়;
‘আমার স্কুলের বান্ধবী’ - পরিচয় শেষে সলজ্জ সম্ভাষণ ।
তারাভরা আকাশের ঝিকমিকে আলোয় দূরে চলে যাওয়া মেয়েটির দিকে চেয়ে ভাবে, ‘বেশ আছে’; আজ হিমানীর চোখের কোলেও তারার ঝিকমিক।

***


২টি মন্তব্য: