মঙ্গলবার, ৬ অক্টোবর, ২০১৫

আশ্রয়

ঘরের লাগোয়া ব্যলকনিটা তার বড় প্রিয়।
সেই কোন ছেলেবেলায় বাবা মায়ের হাতধরে এই ফ্ল্যাটে উঠে আসা,
‘আজ থেকে এটাই আমাদের বাড়ি, আর এই ঘরটা তোমার’ –
কথাটা শেষ না হতেই, একছুটে পৌঁছে গেছিল নরম রোদ মাখা বারান্দাটায় ছোট্ট তিন্নি,
‘আর এটা?’ ‘এটাও তোমার’ বাবা হেসে কোঁকড়া চুলগুলো ঘেঁটে দিয়েছিলেন পরম আদরে।
সেই থেকে, বাড়ির এই বাড়তি কোনাটা তার একমুঠো আকাশ আর চিলতে রোদকে সঙ্গী করে
হয়ে ওঠে তিন্নির বড় আপনার,
একা একা এক্কাদোক্কা খেলা, গল্পের বইয়ে পাতায় হারিয়ে যাওয়া;
আর তারও পরে, লাল বাঁধাই খাতায় কবিতার আঁকিবুঁকি  –
এর সবকিছুই যে ওই বারান্দার নিশ্চিন্ত ঘেরাটোপে,
এই টুকরো জায়গাটুকু তার একান্ত নিজের,
যার ভাগ দেওয়া যায় না কাউকে।

রাস্তার ধারের কৃষ্ণচূড়া গাছটা ছায়া ফেলে বারান্দার রেলিঙে,
বাতাসে শুষ্কতার শিরশিরানি যেন আসন্ন শীতেরপূর্বাভাস;
সামনের পার্কটাতে পাঁজরা বের করে দাঁড়িয়ে আছে প্যন্ডেলের কাঠামো
উৎসব শেষে, হত-গৌরব ভাঙা দেউলির মত।
গাছের ডালে বসা কাকটাকে হুড়ো দিতে গিয়ে হেসে ফেলে তিন্নি,
এই চুয়াল্লিশে এসব বোধহয় মানায় না;
মানায় না তো আরও কতকিছুই -
ব্যাবসায়ী স্বামীর সাফল্যের চেয়ে তার ব্যভীচারকে বড় করে দেখা,
ছেলেটার ভবিষ্যৎ না ভেবেই এক কাপড়ে তেজ দেখিয়ে বেরিয়ে আসা।
বুড়ো বাপ মার কাছে ফিরে এসে সেই বাড়িটায় ওঠা, যা সে নিজের বলেই জানত,
ভারি বেমানান সেটাও আজ সকলের চোখে।
একটা দীর্ঘশ্বাস বাতাস ভারী করে দেয় আচমকা,
খর হয়ে ওঠে কার্তিকের নরম সকাল।

একটু পরে আসবে কোন্নগরের পিসি ডাক্তার গৃহিণী মেয়ে নিয়ে,
উপলক্ষ বিজয়ার শিষ্টাচার,তবে লক্ষটা যে তিন্নি সেটা সহজবোধ্য;
স্কুলের সব পরীক্ষায় এগিয়ে থাকা তিন্নিকে পেছনে ফেলে,
লাল টিপ আর জামদানীতে ঝলমলে ছোট বোন এখন ডার্বি জেতা ঘোড়া;
গলার কাছে দলা পাকিয়ে ওঠা কষ্টটাকে পেছনে ঠেলে দিতে গিয়ে ভেজে চোখ।
‘কা কা’ হেড়ে গলার হুঙ্কারে যুদ্ধের আহ্বান জাগিয়ে
প্রতিবাদী কাকটা রেলিঙে এসে বসে,
না চাইতেই ঠোঁটের কোন বেঁকে যায় হাসিতে,
কাকটার সাথে গলা মেলায় চুয়াল্লিশের তিন্নি,
ঝিরি ঝিরি বাতাসের দোলায় খসে পরে পাতা ঝুরো চুলের এলমেলো সিঁথিতে।
বারান্দাটা নতুন করে বড় কাছের মনে হয়,
শৈশবের স্বপ্নমাখা, নিশ্চিন্ত আশ্রয়।

***
অনন্যা পাল
৭ই অক্টোবর, ২০১৫

৪টি মন্তব্য: