বৃহস্পতিবার, ১১ আগস্ট, ২০১৬

কুড়োনো মাণিক

মহল্লার সবচেয়ে বড় দোকানটা সাবির মিঞার, শাড়ীর সম্ভার সেখানে চোখ ধাঁধানো;
ছেলেটার সাথে আমার সেখানেই দেখা, ফুফার পাশে পাশে শাড়ী দেখায় –
লক্ষ্য করেছি দাম নিয়ে মতবিরোধে, আমার হয়ে সুপারিশ করে হামেশাই;
‘ছেলেমানুষ, ঝানু দোকানদার তো নয়’ স্নেহ অনুভব করি মনে মনে।
সেবার বন্ধু এসেছেন কোলকাতা থেকে, জামদানী পাড়ায় যেতেই হয় অতএব,
এমন কপাল, সাবির মিঞা গেছেন মহাজনের কাছে, দোকান বন্ধ;
ভাবছি দাঁড়িয়ে কি করি, বান্ধবীও আশাহত,
‘আপা আসেন ইদিকে’ পাশের খুপরি দোকানটা থেকে উঁকি দিলো ছেলেটার হাসি মুখ।
 একটু ইতস্তত করে এগোই,’এটা কার দোকান?’
‘আল্লাহ্‌র দোয়ায় আমারই’ ছেলেটার সলজ্জ উত্তর, সেইসঙ্গে এগিয়ে দেওয়া ছাপা কার্ডটা থেকে প্রথম জানলাম ওর নাম দিলাবার।

‘শাড়ী দেখাতে পারবেন কিছু পছন্দসই?’ আমি তখনও ধ্বন্দে;
রঙ আর ডিজাইনে আমার পছন্দ যে একটু ব্যতিক্রমী; –
বান্ধবীও শিল্পীমনা, সাদামাটায় মন উঠবে না জানি।
‘শুধু পাঁচটা শাড়ী দেখাবো আপনাকে’, ‘মোটে পাঁচটা? আর নেই বুঝি?’ –
আমি আঁতকে উঠি;
‘আছে আলমারি ভরা, কিন্তু সেসব আপনার জন্যে নয়, দেখুনই না আগে’,
মুচকি হেসে বুঝিবা চ্যালেঞ্জ জানায় দিলাবার।
পাঁচখানাই দেখিয়েছিল সেদিন; আমরা পলক ফেরাতে পারিনি।
ভয়ে ভয়ে দাম জানতে চেয়ে হোঁচট খেলাম –
এতো অবিশ্বাস্য রকমের কম! গোলমাল আছে কিছু শাড়ীতে?
বিভ্রান্তি নিয়ে ছেলেটার চোখের দিকে তাকিয়ে মিলল সব প্রশ্নের উত্তর;
‘আপনি আমার বইন, আপনার জন্যে আলাদা দাম’, কথাটা বিশ্বাস করেছিলাম সেদিন।
 এরপর থেকে দিলাবারের কাছেই যাই শাড়ীর খোঁজে,
পাঠাই বন্ধুদেরও –
দাম নিয়ে অভিযোগ করেনি কেউই, শাড়ীর মান নিয়েও নয়।

গরমের  ছুটিতে বেড়ানোর লম্বা পরিকল্পনায় অনেকদিন বাড়িছাড়া,
ইতিমধ্যে এলো সেই দুর্যোগময় রাত,শোকে স্তব্ধ ঢাকা –
আটকে পড়লাম কোলকাতায় আরও বেশ কিছুদিন।
প্রায় দুমাস পর ক্লান্ত শরীর, বিষণ্ণ মন নিয়ে ফিরলাম বাড়ী,
একটু গুছিয়ে নিয়ে মনে পড়ল, দিলাবারকে একটা শাড়ীর অর্ডার দেওয়া ছিল,
ফিরেছি জানান দেওয়া চাই, বেচারার টাকা আটকে থাকে নচেৎ।
‘আপা আপনারে ফোনে পাই না, আমার মনটা যে কেমন করে!’ ছেলেটার আকুলতা দুলিয়ে দেয় আমায়;
‘কোলকাতায় ছিলাম, তাই এখানের নম্বরটা বন্ধ ছিল’ আমি বোঝাই।
‘আপনার বাসার এত কাছে ঘটল ঘটনাটা, ফোনে পাই না –
আমি দুইরাত ঘুমাই নাই, মানত করছিলাম মসজিদে;
দুই দিন পর কাগজে নিহতদের নাম পাইয়া, তবে শান্তি; আমার বুইনের কিছু হয় নাই; -
ততক্ষণে আমি ভাষাহারা, লবণাক্ত জলে ভিজে ঠোঁট।
কখন অজান্তে আমার অস্তিত্বকে ভয়ানক দামী করে দিলো ছেলেটা,
আঁকাবাঁকা পথের বাঁকে কুড়িয়ে পেলাম এক অমৃত মাণিক;
জীবনে আর কিছু চাওয়ার বাকী থাকে কি এরপরও?  

***
©1916 ananyapal ALL RIGHTS RESERVED


২টি মন্তব্য: