শনিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

উত্তর মেলেনি

প্রায় দুযুগ আগের কথা, হয়নি বেশিদিন বিয়ের;
ব্যস্ততার জীবনে হঠাৎ পাওয়া ছুটিতে দুজনেই উচ্ছ্বল -
ঠিক হোল যাব দীঘা, বাঙালীর আটপৌরে গন্তব্যস্থল।

দূরপাল্লার বাসে দিলাম পাড়ি,
হালকা শীতের আমেজে আসন্ন উৎসবের আভাস,
বয়সটাও ভালো লাগার;
ছুটির দুটো দিন পাখনা মেলে উড়ে গেল স্বপ্নের ঘোরে।

ফেরার দিন একটা সুখস্মৃতি, কিছুটা বিষন্নতা আর একরাশ ঝিনুকের গয়না ব্যাগবন্দী করে হাজির হলাম বাসস্ট্যান্ডে।
ছুটিফেরতা যাত্রিদের ভীড়ে জায়গাটা সরগরম,
টিকিট পেলাম বটে, তবে প্রায় পেছনের সীটে।
পছন্দের জানলার ধারে বসে, শেষবার দেখে নিচ্ছি বাইরেটা -
বাস ছাড়বার মুখে।

হঠাৎ একটা হৈচৈ, কিছু বোঝার আগেই বাসে উঠে পড়ল এক যুবতীসহ জনা চারেক যুবকের একটা ছোট দল।
শেষ মূহুর্ত্তের টিকিট, কন্ডাক্টর দেখিয়ে দেয় ইঞ্জিনের পাশের চিলতে বেঞ্চ -
বাস কর্মচারীর নির্ধারিত সীট, যা ভীড়ের দিনে যাত্রীদের শেষ ভরসা।
'এয়ার্কি আরকি, আমি বসবো এখানে?' মহিলার স্বরে অমার্জিত ঔদ্ধত্ব,
'আপনি লাস্ট সীটে চলুন, হয়ে যাবে যা হোক করে,
গোবেচারা কন্ডাক্টর আপোশ-উন্মুখ।

'আমি একা বসবো! এরা কি মাগনা উঠেছে বাসে?'
যুবতীর তিরষ্কার জাগিয়ে দেয় সঙ্গীদের পুরুষাকার অচিরেই;
ফলস্বরূপ সীটচ্যুত হয় শেষের সারির কয়েকজন,
এক বৃদ্ধ অসম্মতি জানিয়ে খান গলা ধাক্কা -
বাদ যায় না কন্ডাক্টার ও, সপাট চড় নেমে আসে তার গালে, বৃদ্ধের হেনস্থার প্রতিবাদের জেরে।
বাকী যাত্রীরা সমাহিত হয় নির্বেদ স্তব্ধতায়,
হয়ত ছাপোশা বাঙালীর এ এক অসহায় আত্মনির্যাতন।

বাস চলতে শুরু করে, তার সাথেই শুরু হয় পেছনের সীটে নির্লজ্জ প্রমদ-উল্লাস;
মক্ষীরানিকে ঘিরে চার যুবকের অমার্জিত কথাবার্তায় শিউরে উঠি,
মননিবেশ করি পথসঙ্গী হাতের বইটিতে।

কোলকাতা আসতে আর নেই বেশী দেরী, বাস থামল একটি পেট্রল পাম্পে;
ট্যাঙ্কে ইন্ধনপূর্তী, সাথে ক্ষনিক জলপানের বিরতি।
সকলেই প্রায় নেমেছে বাস থেকে, জল না হোক খোলা বাতাসই বা কম কি?
নেমেছে যুবতীর তিনসঙ্গী,
থেকে গেছে একজন, বুঝিবা একাকী সঙ্গলোভে।

আলগোছে জানলায় হাতরেখে চোখ রাখি সিঁদূরী আকাশে,
অস্তরাগের আভায় ছলকে ওঠে আমার তরুণ মন।
আচমকা কাঁচের পাল্লাটা ঝাঁপিয়ে পড়ে হাতের আঙুলে,
প্রচন্ড ব্যাথায় সরিয়ে আনি হাত,
চোখে জল আসে তীব্র আঘাতে।
'জানলাটা বন্ধ করলি কেন?' যুবক ধমকে ওঠে ক্ষনপূর্বের প্রণয়িনীকে,
তার কর্কশতায় থমকে যায় উদ্ধত যুবতী।

'খুব লেগেছে আপনার? একটু জল দেবেন হাতে?' প্রশ্নটা আমাকে,
যুবকের প্রশ্নে স্পষ্ট উদ্বেগ, কোমল ব্যঞ্জনায় আফসোসের ছোঁয়া
বিস্ময়ে বাক্যহারা আমি মাথা নেড়ে অসম্মতি জানাই।
বাকি রাস্তা মেয়েটি নিশ্চুপ,
আমার মনেও বিস্মিত জিজ্ঞাসা।

এরপর কেটে গেছে বহূকাল,
জীবনের পরোতে পরোতে জমেছে অভিজ্ঞতার পলি;
তবু সেদিনের অসঙ্গতির  আজ ও উত্তর মেলেনি।

***

1 টি মন্তব্য: