সোমবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

সবুজের সমারোহে

নিবিড় বনছায়ার অমোঘ নিস্তব্ধতা ভারি প্রাণবন্ত,
পাতা ঝড়ার অস্পষ্ট শব্দ যেন প্রকৃতির হৃদস্পন্দন,
বিরামহীন নৈঃশব্দে অদ্ভুত শান্তির নিমগ্নতা;
আলিঙ্গনবদ্ধ গাছের সাড়ির ফাঁকে জেগে আছে গলিপথ,
আধো অন্ধকারে, আবছায়া; 
সেই অচেনা পথের বাঁকে খুঁজে পাই আমার ‘আমি’ কে,
হারিয়েছিলাম যাকে চেনা জীবনের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে।

সপ্তাহান্তের ছুটিতে ঢাকার হট্টগোল থেকে বিরাম নিতে ঠিক হোল যাব শ্রীমঙ্গল। সিলেটের কাছাকাছি চা বাগানের দেশ এই জায়গাটি মাত্র ঘন্টা চারেকের রাস্তা গাড়ীতে; অতএব ভোর থাকতেই বেরিয়ে পরা গেলো। বসন্ত সমাগত প্রায়, তবু আঁধার করা কুয়াশায় কয়েক হাত দূরের জিনিষও অদৃশ্য; তাই যাত্রার শুরুটা বেশ রোমহর্ষকই হোল বলতে হয়। এভাবে কুমিল্যা পার হয়ে হাইওয়ের ধারে ‘উজান বাটী’ ধাবায় নিলাম জলখাবারের বিরতি; সুস্বাদু ও পরিচ্ছন্ন ব্যবস্থায় খাওয়া দাওয়া হোল এলাহি এবং বিরতি একটু বেশীই লম্বা। ধাবার ভেতরেই এক মজাদার খাদি দোকান, তাতে কাঁথা কাজের চাদর, বাটিকের শাড়ী, খদ্দরের পোশাক এসবের সাশ্রয়ী সম্ভার; সেখানে বেশ খানিক শপিং করে ফেললাম। দ্বিতীয় দফার যাত্রায়, পথের দুধারে যতদূর চোখ যায় ঘন সবুজের খেলা দেখতে দেখতে গন্তব্যে পৌঁছানোর ইচ্ছেটাই ক্রমে চলে যাচ্ছিল, মন ভালো করা এই পথের শেষ যেন না হয় এটাই ভাবতে শুরু করেছিলাম কখন আনমনে।
এই পথ যদি না শেষ হয়...
আসতে আসতে প্রকৃতির পরিবর্তিত রূপ দেখে মালুম হোল, পার্বত্য উপত্যকার চা বাগানের দেশে এসে পড়েছি আমরা। দুপাশের ঢালু জমিতে ঘন সবুজ চা বাগান আর মাঝে মাঝে সোনালি রবার গাছের সারি, মাঝখান দিয়ে পাহাড়ী রাস্তা কুয়াশার পাতলা চাদরে মোড়া। একটা দুটো ঘুমন্ত শহরতলী পেরিয়ে পৌছলাম আমাদের গন্তব্য গ্র্যান্ড সুলতান রিসোর্টে। রিসেপশনে জানালো আমরা হাজির হয়েছি সময়ের আগেই, ঘর গোছাতে সময় লাগবে কিছুটা। অতএব, লাগেজ জমা করে বেরিয়ে পরলাম রিসোর্টের ভেতরটা ঘুরে দেখতে। বাইরে দিকের কিছুটা অংশে হোটেল কতৃপক্ষ অনাবাসী টুরিস্টদের সময় কাটানোর ছাড়পত্র দেন; সেখানে গিয়ে দেখি নানারঙের এক মজার হাট। পয়লা ফাগুন (বাংলাদেশের প্রেম দিবস) পালন করতে সেখানে ঝাঁকে ঝাঁকে কমবয়সী ছেলে মেয়ে ঘুরে নয় উড়ে বেড়াচ্ছে বলাই ভালো। আমরা (আমি ও আমার কর্তা) একটু তফাতে কফিশপে বসে তাদের লক্ষ করছি, হঠাৎ দেখি কয়েকজন যুবক হাতে ডান্ডা নিয়ে উদ্ভভ্রান্তের মত কৃত্রিম হ্রদের চারপাশে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, মনে মনে শঙ্কিত হলাম, এ আবার কি উৎপাত! ‘আরে ডান্ডা কোথায়, সেলফি স্টিক নিয়ে ঘুরছে’ কর্তা আস্বস্ত করলেন; বাহারে পরিমন্ডলে নিজের ছবি তুলে ফেসবুকে দেবার চাপ তো কম নয়!
সবুজের দেশে

রবার গাছের সাড়ি
হোটেলেও সবুজের ঘেরাটোপ



পথের বাঁকে
টিলার ওপর শান্তির নীড়
পরদিন প্রাতঃরাশ সেরে আমরা গেলাম লাউয়াছড়া সংরক্ষিত বন দেখতে, কয়েক কিলমিটারের মধ্যেই তার অবস্থান সেখানে বনের অন্দরে সবুজের সমারোহ শান্ত সমাহিত, পায়চলা পথে হাটতে হাটতে চমকে উঠি পাতা ঝরার শিরশিরে শব্দে পাখিদের কলতান কোথাও জাগিয়ে তোলে সুরের লহরী, প্রজাপতির ঝাঁক খেলে বেড়ায় কোথাও আপন খেয়ালে বনের পথে কিছুটা সময় কাটিয়ে আমাদের সারথীর উৎসাহে রওনা দিই মাধবপুর চা বাগানের দিকে একে ওকে জিজ্ঞাসা করে পৌঁছুতে লেগে গেলো খানিকটা সময়, ফলে দেখা হয়ে গেলো কিছূ গ্রামের বসতি ও চা বাগানের জীবনযাত্রা সেদিনটা ছিল সরস্বতী পূজোর পরেরদিন, বাগানের কচিকাচাদের প্যান্ডেল ঘিরে উৎসাহ দেখে মনে পড়ে যাচ্ছিল নিজের ছোটবেলা মাধবপুর বা ন্যাশনাল টি কম্পানীর চা বাগানে আছে পাহাড় ঘেরা ভারি সুন্দর একটি কৃত্রিম হ্রদ, ব্রিটিশ মালিকানা কালীন সময়ে সেটি তৈরী হয়েছিল বাগানে জল সরবরাহের জন্যে সেই লেকের জলে থরে থরে ফুটে আছে দেখলাম বেগুনী রঙের শালুক, আমার অনভ্যস্ত চোখে সে যেন রূপকথার দুধসায়রে নীলপদ্মের বন; যেখানে লুকিয়ে আছেন কুঁচবরণ রাজকন্যে ভিনদেশী রাজপুত্রের অপেক্ষায়      

বনের একপাশে রেললাইন

বনপথে




যেখানে প্রজাপতি, সেখানে আছে সেও
দোয়েল বলে 'টুকি'
বক তপস্বী
দুধসায়র
রাজকন্যে আছেন কি?
মনহরিণী
ফেরার পথে গেলাম শ্রীমঙ্গল বাজারে, সেখানে ‘কুটুমবাড়ি’ নামের একটি রেস্তোরাঁয় তার নাম মাহাত্যেই খেতে ঢুকলাম। খেতে বসে বুঝলাম নাম খানি একেবারে উপযুক্ত; নাহোক দশ রকম শুধু ভর্তাই আছে তাদের মেনুতে, আদর করে খাওয়ানোর ধরণটাও সত্যিই আন্তরিক। রাজকীয় আহার সেরে পাশেই গোপাল ভাঁড়ের ছবি আঁকা ‘পেটুক’ মিষ্টান্ন ভান্ডারে গিয়ে মধ্যান্ন ভোজের মধুরেণ সমাপয়েত করা গেল। এরপরে আমরা খুঁজতে বেরোলাম বিখ্যাত নীলকন্ঠ টি কেবিন, যেখানে কয়েক দশক ধরে পাওয়া যায় আটরঙা চা। আর্মি ক্যান্টনমেন্ট ছাড়িয়ে মেঠো পথের বাঁক নিয়ে অবশেষে পৌছলাম সেখানে, চারপাশে ঘন সবুজের মাঝে একটা ঘুমন্ত মার্কেট স্কোয়ার; চা বিক্রির থেকে শিল্পকর্মটাই যেখানে বড় কথা। বন্ধ দরজার আড়ালে তৈরী হয় এই চা, যদিও ইদানিং কয়েকটা ইমিটেশন বেরিয়েছে, দুঃখ করে জানালেন দোকানের ক্যাশিয়ার। চা টি খেতে খুব উচ্চমার্গের একথা বলা চলেনা, তবে দেখবার জিনিষ সত্যি। এর পাশেই একটি মনিপুরি শিল্পের দোকান এবং পাশেই মনিপুরি পাড়াতে রয়েছে এরকম আরও অনেক কুটির শিল্প বিক্রয় কেন্দ্র দাম ও গুণমানে যা বেশ আকর্ষণীয়।    


সেই চা শিল্প...

আট রঙা চা

অবশেষে পড়ন্ত বেলায় হোটেলে ফিরে ঘরে ঢুকে দেখি রাখা আছে ভ্যালেন্টাইন্স ডে র উপলক্ষে ছোট্ট একটি হার্ট শেপের কেক। বসন্তের আবির রাঙা বিকেলে, ভালবাসা দিবসের গোলাপী হৃদয় পেয়ে সেদিন মন্দ লাগেনি একথা স্বীকার করতে বাধা নেই।
সব মিলিয়ে দুটো দিন যেন স্বপ্নের ঘোরেই কেটে গেলো, পরদিন সকালে ঢাকার পথে পাড়ি দিতে দিতে মনে হোল ওই সবুজের সমারোহের ছোঁয়া রাঙিয়ে দিয়েছে আমার শহুরে মনটাকেও কখন অজান্তে; আর সেটাই এই ছুটির অভিযানে আমার বড় পাওনা।
***

©1916 ananyapal ALL RIGHTS RESERVED

All photographs are copyrighted by Dilip Pal ©1916 dilippal ALL RIGHTS RESERVED

৩টি মন্তব্য:

  1. "bonopotho maajhe, chhaya ghera saanjhe, kaar nupur baaje go paye, ke go gagori bhorone jay.." chhobigulo dekhte dekhte ei gaanta mone elo. Tomar lekhar kotha ar ki bolbo, mone holo, tomar songe amaro ghora hoye galo. Mojar kotha-- dekhi tumio ekhono rupkothar porider khonjo! Amio khunji. August maase plane e kolkata jabar somoy megher rajye probesh korlam jokhon, tokhon sotti mone hochhilo, ei bujhi haalka dana mele pori ese megher opor bosbe! Pori rajyer motoi sundor sei drishyo. :).

    উত্তরমুছুন
  2. সাধারণ বা আমাদের মতো স্থানীয়দের কাছে যা আটপৌরে....দিনানুদিনের....একজন ভ্রমণপ্রিয় মানুষের প্রেক্ষণবিন্দু ও লেখনিমুন্সিয়ানায় তাই হয়ে ওঠে অসাধারণ, সুখপাঠ্য। হালে সিলেট এলাকায় গ্র্যান্ড সুলতানের মতো বেশ ক'টি পাঁচতারা রিসোর্ট হয়েছে, যার সেবার মান উন্নত। এই লেখক কুষ্টিয়া-মেহেরপুর অঞ্চল, দিনাজপুর অঞ্চল এবং সুন্দরবন ও খুলনা অঞ্চল ভ্রমণের অনুরোধ রাখতে পারি। কুষ্টিয়ায় তিনি দেখতে পাবেন রবীন্দ্র লালন-মোশাররফ-কাঙাল হরিনাথ-জলধর সেনের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহ্যবাহী কুমারখালী, ঠাকুর পরিবারের জমিদারির শিলাইদহ, লালনের আখড়াবাড়ি, কাঙালকুটির, ঐতিহ্যের তাঁতশিল্প ইত্যাদি।

    উত্তরমুছুন
  3. সাধারণ বা আমাদের মতো স্থানীয়দের কাছে যা আটপৌরে....দিনানুদিনের....একজন ভ্রমণপ্রিয় মানুষের প্রেক্ষণবিন্দু ও লেখনিমুন্সিয়ানায় তাই হয়ে ওঠে অসাধারণ, সুখপাঠ্য। হালে সিলেট এলাকায় গ্র্যান্ড সুলতানের মতো বেশ ক'টি পাঁচতারা রিসোর্ট হয়েছে, যার সেবার মান উন্নত। এই লেখক কুষ্টিয়া-মেহেরপুর অঞ্চল, দিনাজপুর অঞ্চল এবং সুন্দরবন ও খুলনা অঞ্চল ভ্রমণের অনুরোধ রাখতে পারি। কুষ্টিয়ায় তিনি দেখতে পাবেন রবীন্দ্র লালন-মোশাররফ-কাঙাল হরিনাথ-জলধর সেনের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহ্যবাহী কুমারখালী, ঠাকুর পরিবারের জমিদারির শিলাইদহ, লালনের আখড়াবাড়ি, কাঙালকুটির, ঐতিহ্যের তাঁতশিল্প ইত্যাদি।

    উত্তরমুছুন