বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী, ২০১৪

কুল না ফুল?


শীতের দুপুরে মেয়েকে সাথে নিয়ে গেছি একজোড়া চটি কিনতে, তা অনেক দেখা দেখি করে একটা বেশ পছন্দ হল; কিন্তু আমার আধুনিকা কিশোরী মেয়ে ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল ‘লুক অ্যাট ইয়োর ফিট মাম্মা ইটস নট কুল!’ মেয়েকে গ্রাহ্য না করে জুতোটা কিনে বাইরে এসে মনে হোল কথাটা বোধহয় মিথ্যে নয়, ঠাণ্ডায় এবং অযত্নে আমার চরণ যুগল প্রায় কাকের ঠ্যাং এ পরিণত হয়েছে। কথাটা মাথায় ঘুরছিলো, হঠাৎ রাস্তার মোড়ে একটা ভারি চমকদার বিউটি পার্লার চোখে পরল। ভাবলাম বরং এখান থেকে খানিক পদমার্জনা করিয়ে পায়ের ভোল ফেরাই; তাতে পা দুখানা আমার প্রাণপাতের না হোক অন্ততঃ প্রনিপাতের* যোগ্য তো হবে (প্রসঙ্গতঃ গীতগোবিন্দে কেষ্ট ঠাকুর ‘দেহি পদ পল্লব মুদারম’ বলে শ্রীরাধার চরণে প্রাণটা প্রায় দিয়েই ফেলেছিলেন আর কি)! যেমন ভাবা, আমরা মা মেয়ে ঢুকলাম ভেতরে; ঢুকতেই কাউনটারের মেয়েটি কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়েই আগে নাম ঠিকানা মোবাইল নম্বর লিখে নিল। প্রথম ধাক্কা সামলে নিজের প্রয়োজনের কথা জানালাম; যাই হোক আর একটি মেয়ে বেশ যত্ন করে ভেতরে নিয়ে বসিয়ে পদসেবা শুরু করল গরম জলের ছ্যাঁকা, নরুনের খোঁচা আর খামচাখামচির মাঝখানে হঠাৎ দেখি এক অতি সুসজ্জিতা মহিলা ভারি আন্তরিক ভাবে আলাপ করতে এলেন। মহিলার চাকচিক্যে আমি তো মোহিত, জানতে পারলাম ইনিই পার্লারের দিদিমণি, মানে মালকিন আর কি। ‘তা ভাই আপনি ফেসিয়াল কোত্থেকে করান আপনার স্কিন কিন্তু খুব ভালো’ ওঁর প্রশংসা বাক্য আমাকে শাড়ীর দোকানের কর্মচারীদের কথা মনে করিয়ে দিল, পৃথিবীতে একমাত্র ওরাই আমাকে ‘ফরসা’ বলে থাকে শাড়ী গছানোর জন্যে। ‘করিনা তাই ভালো আছে’ কথাটা কেমন মুখ ফসকে বেরিয়ে গেলো, তবে মহিলা ওধার দিয়েও গেলেন না। ‘সেকি ফেসিয়াল করেন না, তবে আজই শুরু করুন’। ‘কিন্তু আপনি তো বললেন স্কিন ভালো’ আমার জবাব। ‘আহা হা, এখন ভালো আছে, কিন্তু আচমকা একদিন সকালে উঠে দেখবেন চামড়া একেবারে কুঁচকে গেছে। আর ফেসিয়াল করলে বহুদিন আপনি একই রকম সুন্দরী থাকবেন’, আবার শাড়ী দোকানের কথাটা মনে হোল যা হোক বুড়ো হতে আমার তেমন আপত্তি নেই; আর তাছাড়া আপত্তি করলেই কি আর বুড়ো হওয়া ঠেকানো যাবে? কিন্তু হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে আয়ানায় নিজের কোঁচকান মুখ দেখতে ভালো লাগবে কিনা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। তাই জিজ্ঞসা করলাম ‘তা আপনাদের কিরকম চার্জ টার্জ?’ ‘দেখুন ফেসিয়াল অনেক রকম, তবে আপনার জন্য গোল্ডটাই সবচেয়ে ভালো হবে’। ‘গোল্ড! মানে সোনা?’ আমি তো হতচকিত। ‘হ্যাঁ একেবারে ২৪ ক্যারাট’। ‘নানা সেকি, সোনার তো আজকাল এমন দাম যে নাম মুখে আনতেও ভয় লাগে। গেলো বছর মামাতো ভায়ের বিয়েতেই সোনা দিতে পারিনি আর শেষে কিনা মুখে মেখে নষ্ট করবো’! আঁতকে উঠে বলি। ‘তাহলে এক কাজ করুন আপনি বরং পার্ল ফাসিয়াল করুন, আপনাকে খুব সুট করবে’। ‘পার্ল মানে আপনি মুক্তোর কথা বলছেন? সেটাও নিশ্চয়ই আসল?’ আমার প্রশ্নে দিদিমণি মিষ্টি করে হেসে সায় দিলেন। ‘দেখুন, এক আধ ছড়া মুক্তোর হার আমার আছে বটে কিন্তু সেতো সবই হায়দ্রাবাদী। আসল মুক্ত তো কেবল মিউসিয়ামেই দেখেছি। এতটা বাড়াবাড়ি করা বোধহয় ঠিক হবে না’। ‘বেশ তবে বরং আপনি ফ্রুট ফেসিয়াল করুন, সেই বা মন্দ কি!’ মহিলাকে যত দেখছি ওঁর প্রতি শ্রদ্ধা যেন আমার বেড়ে উঠতে লাগলো। ‘তা ফ্রুট ফাসিয়ালের ব্যাপার টা কি?’ আমি বেশ কৌতহল বোধ করলাম। ছেলে ভোলানো মায়ের স্নেহে দিদিমণি বোঝাতে লাগলেন, ‘দেখুন আঙুর, পেঁপে, বেদানা, এই যে সব ভালো ভালো ফল এই দিয়েই আমাদের ফ্রুট ফেসিয়াল; স্কিনের পক্ষে ভারি ভালো’। ‘সেকি ফলের যা দাম, তা এগুলো মুখে মেখে নষ্ট না করে খেলে ভালো হয় না?’ এতক্ষণে দিদিমণির মাখন গালে একটু বিরক্তির ভাঁজ পরলো, ‘তা আপনার যা বাজেট মনে হচ্ছে তাতে আপনি হারবাল ফেসিয়াল করুন’। ‘সেটা কি রকম?’ আমি এখনো কৌতুহলি। ‘এ হোল গিয়ে শাক সবজি লতা পাতার ব্যাপারযাক তাহলে এটাই আমার পক্ষে ভালো। আজই বাড়ী গিয়ে রান্নাঘরের জিনিষ টিনিষ দিয়ে ব্যাপারটা সেরে ফেলব এখনএতক্ষণে আমি স্বস্তির নিঃশাস ফেলি। তাড়াতাড়ি পদসেবার বিল মিটিয়ে মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে এলাম। দিদিমণিও আঁধার মুখে আমাকে বেড়াল পার করে বাঁচলেন।

মেয়ের মুখ দেখে অনুমান করলাম সে একটুও খুশী নয় আমার ব্যাবহারে। বুঝলাম, ফুল (fool) হতে চাইনি বলে কুল (cool) হওয়া আমার হোলনা!

* যারা আমার মত সেকেলে বুড়ি নয় তাদের সুবিধার্থে জানাই, প্রনিপাত মানে প্রণাম করা; তা আজকাল প্রণামের রেওয়াজ যেমন উঠে গেছে এসব শব্দের প্রয়োজনও তেমন ফুরিয়েছে।

*****
Published in Prothom Alo on 4th April, 2016

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন